This is default featured slide 1 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 2 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 3 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 4 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

This is default featured slide 5 title

Go to Blogger edit html and find these sentences.Now replace these sentences with your own descriptions.

বুধবার, ২০ জুলাই, ২০১৬

পাকিস্তান আমল এবং জামায়াত


দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের জন্ম হয়। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ এই বিষয়টার বিরোধীতা করেন। অনেকে মনে করেন তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেন। মূলত বিষয়টা তা নয়। জিন্নাহসহ মুসলিম লীগ প্রচার করে তারা মদীনা রাষ্ট্রের মত করে ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করবেন। মদীনাতে যেভাবে মক্কা থেকে সবাই এসে রাষ্ট্র কায়েম করেছে ঠিক তেমনি সারা ভারতবর্ষ থেকে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে একত্র হয়ে রাষ্ট্র কায়েম হবে। এখানে কুরআন হবে সংবিধান। বেসিক্যলি মওদুদী সাহেব এখানে বিরোধীতা করেন তিনি বলেন জাতীয়তাবাদী চেতনা দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। [১,২]
জিন্নাহ সাহেবেরা মুসলিম জাতীয়তাবাদ দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। এভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। মূলত কিভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হয় তা নিয়ে তিনি একটি লেকচার দেন যা বই আকারে প্রকাশিত হয় “ইসলামী হুকুমাত কিস্তারা কায়েম হতি হায়” যা আমরা পড়ি ইসলামী বিপ্লবের পথ।

১৯৪৭ সালে ইংরেজরাও চেয়েছিলো ভারত ভেঙ্গে যাক। তাহলে তাদের ডিভাইড এন্ড রুল খেলতে ভালো হবে। ১৯০ বছরের দুঃশাসন ও শোষন ভুলাতে এটা ছাড়া তাদের বিকল্প ছিল না। তাই তারা মুসলিমদের দাবীকে গুরুত্ব দিয়ে ভারতকে দু’ভাগ করে এবং এতে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ লেগে যায়। দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। কিছুদিন আগেই যাদের শত্রু ছিল ইংল্যান্ড এখন তাদের শত্রু পরিবর্তন হয়ে যায়। ভারতের শত্রু হয় পাকিস্তান আর পাকিস্তানের ভারত। আর ইংল্যান্ড উভয়ের মোড়ল বা অভিভাবকের ভূমিকায় অবতীর্ন হয়।

যাই হোক পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে। ভারত আয়তনে বড় হলেও পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দ্বারা ভারতের মূল ভূখন্ড ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যায়। যুদ্ধাবস্থায় এই বিষয়টি পাকিস্তানের অনুকূলে আসে। এক বছরের অধিক সময় ধরে যুদ্ধ চলে। উভয় দেশের অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। সাময়িক সমজোতার মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান হয়। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করার পরিকল্পনা করে ভারত। তাহলে ভারতকে আর পাকিস্তান দ্বারা বেষ্টিত থাকতে হয় না।

পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল ছিলেন জিন্নাহ। তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। ১৯৪৮ সাল থেকেই জামায়াত ইসলামী সরকার এবং ইসলামী সংবিধানের জন্য আন্দোলন করতে থাকে। জামায়াত ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা তৈরী করে এবং এই রূপরেখা গ্রহনের আহ্বান জানায়। ১৯৪৮ সালে সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ সহ অনেকে গ্রেপ্তার হন। এতে আন্দোলন দমে যায়নি। বরং দ্বিগুন তেজে জ্বলে উঠে।এর মধ্যে জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। লিয়াকত আলী খান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তিনি ১৯৪৯ সালে জামায়াতের “ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা” গ্রহন করেন। সে বছর পাকিস্তানে জেনারেল আকবর খানের নেতৃত্বে ১ম সেনাবাহিনীতে ক্যু হয়। সেনাপ্রধান আইয়ুব খানের কারণে সে ক্যু ব্যার্থ হয়। ১৯৫০ সালে সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ মুক্তি পান। ১৯৫১ সালে লিয়াকত সাহেব আততায়ীর গুলিতে ইন্তেকাল করেন। [২]

ভাষা আন্দোলনঃ 
ভাষা আন্দোলনকে আমার মনে হয়েছে বাঙ্গালী জাতির সংকীর্ণতা। তাই আদতেই আমি এর বিপক্ষে। কোন ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা না হলে সেই ভাষা ধ্বংস হয়ে যায় না। এটি তৎকালীন পাকিস্তানের সংহতির বিরোধী। পাকিস্তানী নেতারা (ইনক্লুডেড বাঙ্গালী) এমন একটি ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করেছে যা মাত্র ৩-৪ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ছিল। এটি সহজ এবং বোধগম্য ছিল। কোন নেতারই এটা মাতৃভাষা ছিল না। তাছাড়া উর্দু মুসলিমদের ভাষার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুসলিম লীগ গঠনের পর থেকেই।

হিন্দি নামটি ফার্সি থেকে এসেছে। পারস্যের অধিবাসীরা ভারতীয় লোক ও তাদের ভাষাকে হিন্দি নামে ডাকত। ইতিহাসবিদেরা তাই মনে করেন। ৮ম-১০ম শতকের দিকে ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময় উত্তর ভারতের খারি বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা, এবং বহিরাগত মুসলিম শাসকেরা সাধারণ জনগণের সাথে যোগাযোগের জন্য এই ভাষাই ব্যবহার করতেন। এই খাড়ি বোলি ভাষার একটি রূপ ধীরে ধীরে ফার্সি ও আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার করলে উর্দু নামের এক সাহিত্যিক ভাষার উদ্ভব ঘটে। উর্দু শব্দটি তুর্কি "ওর্দু" শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ "শিবির" বা "ক্যাম্প"। অন্যদিকে সাধারণ জনগণের মুখের ভাষায় আরবি-ফার্সির তেমন প্রভাব পড়েনি, বরং তারা সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ ও সাহিত্যিক রীতি ধার করতে শুরু করে এবং এভাবে হিন্দি ভাষার জন্ম হয়। সেই হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে উপমহাদেশের মুসলিমরা উর্দু আর অন্যরা হিন্দি ভাষায় কথা বলতো। পাকিস্তানের সেসময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মাতৃভাষাগুলো ছিল বাংলা, পাঞ্জাবী, বেলুচ, সিন্ধি, পশতু ইত্যাদি। এর মধ্যে উর্দুই ছিল বোধগম্যতার দিক দিয়ে কমন যা হিন্দীর অনুরূপ। তাই এই ভাষাই মুসলিমদের ভাষা হয়ে উঠে।[৩]

হিন্দি ভাষা দেবনাগরী লিপিতে লেখা হয় এবং এর শব্দভাণ্ডারের বেশির ভাগই সংস্কৃত থেকে এসেছে। অন্যদিকে উর্দু ভাষা ফার্সি লিপিতে লেখা এবং এর শব্দভাণ্ডার ফার্সি ও আরবি থেকে বহু ঋণ নিয়েছে। এছাড়া ভাষা দুইটির ধ্বনি ব্যবস্থা ও ব্যাকরণেও সামান্য পার্থক্য আছে। ১২শ শতক থেকে উর্দু ও হিন্দি উভয় ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ১৮শ শতকে ইংরেজির প্রভাবে উর্দু ও হিন্দি সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। [৩,৪]

মুসলিম লীগের তথা পাকিস্তানের তৎকালীন নেতারা তাদের প্রদেশগুলোর মধ্যে কমন ভাষা চালু করার জন্যই উর্দুকে সিলেক্ট করেছে। আর বিষয়টা এমন ছিল না যে উর্দু অপ্রত্যাশিতভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। প্রত্যেক জাতি তাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা থেকে বঞ্চিত করেছে সংহতি রক্ষার জন্য। শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সভ্যতার সীমা ছাড়িয়েছে আমাদের কিছু বাঙ্গালী। বাংলার সব মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিল এটাও সঠিক নয়। ঢাকায় সেসময় প্রচুর ছাত্র উর্দুর পক্ষেও ভূমিকা রেখেছিলো। বাংলার কোন রাজনৈতিক নেতা বায়ান্নোর আগ পর্যন্ত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে ছিলেন না। ঢাকা ভার্সিটি ও জগন্নাথ কলেজের (তখন কলেজ ছিল) কিছু ছাত্র ছাড়া এই আন্দোলন কেউ করেনি।

আর সবচেয়ে মজার বিষয় হলো ২১ ফেব্রুয়ারীর ঘটনায় আমরা অবাঙ্গালী পাকিস্তানীদের দোষারোপ করি। অথচ আমাদের মনে থাকে না আমরাই পাকিস্তানের শাসক ছিলাম। তৎকালীন পাকিস্তানে আমরা ৫৬ শতাংশ ছিলাম। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনা আলোচনায় আসলেই আমরা ঐ সময়ের পশ্চিম পাকিস্তানীদের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে বিষোধগার করি এবং বলে থাকি ৫৬ শতাংশ মানুষের উপর উর্দু চাপিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ সেই তারা হলেন বাঙ্গালীরাই। ১৯৫২ তে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বাঙ্গালী খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ঢাকার নবাব ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের যারা আন্দোলনকারী, যারা আন্দোলন দমনকারী, যারা জেলে গিয়েছে, যারা জেলে নিয়েছে, যারা গুলি করেছে, যারা গুলির নির্দেশ দিয়েছে, যারা গুলিতে মৃত্যুবরণ করেছে সবাই বাঙ্গালী। বামপন্থি কিছু নেতা ছাড়া এদেশের কোন বাঙ্গালী রাজনৈতিক নেতা এবং তাদের অনুসারীরা বাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন না। বামদের গ্রহনযোগ্যতা তৎকালীন ৫২’র পাকিস্তানে ছিল না। 
সেসময়ের বাঙ্গালী শীর্ষ নেতা ছিলেন 
১- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী 
২- নবাব খাজা নাজিমুদ্দিন 
৩- এ কে ফজলুল হক 
৪- মোহাম্মদ আলী বগুড়া 
৫- নুরুল আমীন 
৬- মাওলানা আতাহার আলী 
৭- হাজী মুহাম্মদ দানেশ

ওনারা কেউই রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে ছিলেন না পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করার নিমিত্তে। ভাষা আন্দোলন প্রথমে কিছু সাধারণ ছাত্র এবং খেলাফতে রব্বানীর সাংস্কৃতিক উইং তমুদ্দিন মজলিশের মাধ্যমে শুরু হলেও পরে এটির লক্ষ্য অন্যদিকে পরিবর্তিত হয়। ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে জিন্নাহর বৈঠকে জিন্নাহ তাদের বুঝাতে সক্ষম হন কেন উর্দু জরুরী। আন্দোলন থামিয়ে দিতে চায় তমুদ্দুন মজলিশ। কিন্তু কমরেড তোয়াহা তমুদ্দুন নেতা শামসুল হক থেকে বাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব ছিনিয়ে নিয়ে বামদের আন্দোলনে পরিণত করে। 
এখন স্বাভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে জনবিচ্ছিন্ন এই আন্দোলন কেন সফল হলো?

১- পাকিস্তান রাষ্ট্রে সেসময়ে তখনো কোন স্বৈরশাসক আসেনি। সাধারণ কোন বিষয়ে গুলি চালানোর মানুষের কল্পনার বাইরে ছিল। সাধারণ মানুষ গুলি চালানো মেনে নিতে পারেনি। আন্দোলন কারীদের প্রতি সবাই সিম্পেথাইজড হয়। দাবিটাও জোরালো হয়। আর এতেই পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরে যায়। যদিও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে সেদিন সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে না। কিছু সিদ্ধান্ত অমান্যকারী মিছিল শুরু করলেই পুলিশ গুলি করে।

২- ১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ঐ ঘটনার দায় মুসলিম লীগের উপর চাপিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে এবং ভাষা আন্দোলন তাদের অর্জন এটা প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করেন।

আমি শুরুতে বলেছিলাম ভারত চেয়েছিল পূর্ব-পাকিস্তান কে পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে আলাদা করার জন্য। এই ভাষা আন্দোলনের পেছনে ভারতের যথেষ্ট অবদান আছে। ভাষা আন্দোলনের এই বিষয়টি সর্বপ্রথম জনসম্মুখে আনেন তৎকালে ভারতীয় চর হিসেবে পরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি গণপরিষদে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু গণপরিষদের অন্য কোন সদস্য তার এই প্রস্তাবকে সমর্থন করেননি। বহুজাতি নিয়ে গঠিত পাকিস্তানে এই বক্তব্য সাম্প্রদায়িক বক্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয় এবং তার প্রস্তাব নাকচ হয়।
বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় নিয়ে আসে তথাকথিত প্রগতিবাদী ইসলামী সংগঠন, সমাজতান্ত্রিক ইসলাম ও ধর্মনিরপেক্ষ ইসলামের প্রবক্তা খেলাফতে রব্বানী। তাদেরই কালচারাল উইং তমুদ্দুনে মজলিশ।

কাদিয়ানী সমস্যাঃ 
পাঞ্জাবী লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর ১৯৫১ সালে প্রধানমন্ত্রী হন বাঙ্গালী খাজা নাজিম উদ্দিন। তিনি ১৯৫৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। সে সময় পাকিস্তানে আহমদিয়া বা কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের ব্যপক বিস্তার হয়, পাকিস্তানের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তা এই মতবাদের অনুসারী ছিলেন। সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ তখন 'কাদিয়ানী সমস্যা' নামে একটি বই লিখে কাদিয়ানী বা আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম প্রমাণ করেন এবং এদের রাষ্ট্রীয়ভাবে অমুসলিম ঘোষনার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন বড় ধরণের নাড়া দেয় পাকিস্তানকে। অধিকাংশ মুসলিম এই আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। এ সময় অনেকগুলো সংগঠন একযোগে কাদিয়ানীদেরকে সরকারিভাবে অমুসলিম ঘোষনার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তারা সর্বদলীয় কনভেনশনে ২৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে 'ডাইরেক্ট একশন কমিটি' গঠন করে। জামায়াত এই কমিটির বিরোধিতা করে অহিংস আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু তথাপি মার্চ মাসের শুরুতে আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে এবং পুলিশের গুলিতে কিছু লোক নিহত হয়।

ডাইরেক্ট একশন কমিটি কাদিয়ানীদের কিছু মানুষকে হত্যা করে, এর ফলশ্রুতিতে দাঙ্গা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে খাজা নাজিমুদ্দিন পদত্যাগ করেন। প্রধানমন্ত্রী হন আরেক বাঙ্গালী মোহাম্মদ আলী বগুড়া। তারা সবাই মুসলিম লীগের নেতা। পরিস্থিতি সামাল দিতে মাঠে নামে সেনাবাহিনী। গ্রেপ্তার হন সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ। তার গ্রেপ্তারে আন্দোলন আরো ভয়ংকর হয়। সরকার কাদিয়ানীদের মৌখিকভাবে কাদিয়ানীদের নিষিদ্ধ ঘোষনা করে। পরে একটি সামরিক আদালত সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ কে এই গোলযোগের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়। তবে বহিঃবিশ্বের চাপে সেই দন্ড কার্যকর করতে পারেনি মোহাম্মদ আলী বগুড়ার সরকার। মুক্তি পান সাইয়্যেদ মওদুদী রঃ। [৪,৫]

যুক্তফ্রন্ট সরকারঃ 
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় পরিষদের ১৯৫৪ খ্রীস্টাব্দের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে অন্যান্য দল মিলে যুক্তফ্রন্ট নামীয় একটি সমন্বিত বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। সাথে আরো ছিল মৌলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি। বামপন্থী গনতন্ত্রী দলের নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলি সিলেটি।

১৯৫৪ সালের মার্চের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন অর্জ্জন করে। তন্মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ৪৮টি পেয়েছিল শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামী ইসলাম পার্টি লাভ করেছিল ২২, গণতন্ত্রী দল লাভ করেছির ১৩টি এবং খেলাফত-ই-রাব্বানী নামক দলটি ১টি আসন। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ সম্পূর্ণরূপে এ নির্বাচনে পরাভূত হয় ; তারা কেবল ৯টি আসন লাভ করতে সমর্থ হয়।

এ নির্বাচনে সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য ৭২টি আসন সংরক্ষিত ছিল। এগুলোর মধ্যে কংগ্রেস লাভ করেছিল ২৪টি আসন, কমিউনিস্ট পার্টি ৪টি, শিডিউল্ড কাস্ট ফাউন্ডেশন ২৭টি, গণতন্ত্রী দল ৩টি এবং ইউনাইটেড পগ্রেসিভ পার্টি ১৩টি আসন লাভ করেছিল। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি আসনে জয়ী হয়েছিলেন।

এখানে একটা বিষয় গোলমাল লেগে যায়। সোহরাওয়ার্দী ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের পাকিস্তান সভাপতি। আর ভাসানী ছিলে পূর্ব পাকিস্তান সভাপতি। সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ১৯৫৬ সালে। প্রায় বছরখানেক তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের সংবিধানের খসড়া পাস হয়। এবং এর মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হয়। এতটুকুই ছিল মূলত জামায়াতে ইসলামীর সফলতা। এছাড়া জামায়াতের ইসলামী সংবিধানের রূপরেখার কিছুই গ্রহন করা হয়নি।

নতুন সংবিধানে গভর্ণর জেনারেল সিস্টেম বাদ পড়ে ইস্কান্দর মির্যা হন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। আগে মূলত রাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী দ্বারা পরিচালিত হতো। নতুন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বেড়ে যায়। ইস্কান্দর মির্যার সাথে সোহরাওয়ার্দীর বিরোধ বাড়তে থাকে। ১৯৫৭ সালের অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করেন। এর প্রায় একবছর পর ১৯৫৮ সালে ক্যু করেন আইয়ুব খান। পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। [বাংলাপিডিয়া]

৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ এবং ছয় দফার সৃষ্টিঃ
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক ভারত যুদ্ধ হয়। যুদ্ধটি স্থায়ী ছিল ১৭ দিন। কাশ্মীর সহ নানা ইস্যুতে পাকিস্তানে অতর্কিত আক্রমন করে ভারত। পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত থাকার থাকার কারণে প্রাথমিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়। তবে ৫-৬ দিনের মধ্যেই আইয়ুব খানের রণনৈপুণ্যে ও বাঙ্গালী সৈনিকদের নজিরবিহীন আত্মত্যাগে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। ভারতের প্রায় ৬০ টি বিমান ৪৫০ ট্যাংক ধ্বংস হয়। এমতাবস্থায় ভারত যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগী হয়ে পড়ে। অপরদিকে পাকিস্তানের গোলাবারুদ সংকট ও যুদ্ধক্ষেত্র পাকিস্তান হওয়ায় পাকিস্তানের জনজীবন হুমকির সম্মুখিন। সব মিলিয়ে পাকিস্তানও যুদ্ধ বন্ধের পক্ষে। [উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া]

ভারতের বন্ধু রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং একটা চুক্তি হয়, যা তাসখন্দের চুক্তি বলে অভিহিত। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো ও সাধারণ জনগণ এই চুক্তি মানে নি। এটা ছিল সূবর্ণ সুযোগ কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের। কিন্তু আইয়ুবের কূটনৈতিক ব্যর্থতায় তা হলো না। ক্ষেপে উঠে রাজনীতিবিদেরা ও পাকিস্তানী জেনারেলরা। আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলো জোট গঠনের চেষ্টা করে। এতে নেতৃত্ব দেয় মুসলিম লীগ। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী লাহোরে সেই মিটিঙে আরো অংশগ্রহন করে আওয়ামীলীগ, জামায়াত, নেজামে ইসলাম। আওয়ামীলীগের পূর্বপাকিস্তানের সেক্রেটারী মুজিব সেই প্রোগ্রামে আ. লীগের হয়ে অংশগ্রহন করেন। [৭]

সেই মিটিঙে মুজিব হঠাৎ করে ৬ দফা ঘোষনা করে বসেন। কিন্তু অন্যান্য বিরোধী দল তা মেনে নেন নি। তারা বলেন, আমরা আজ একত্রিত হয়েছি কাশ্মীর, তাসখন্দ ও আইয়ুব খান কে নিয়ে। ফলে মিটিঙের কার্যসূচী থেকে ছয় দফা বাদ পড়ে। মুজিব সভাস্থল ত্যাগ করে। মজার বিষয় হল নিখিল পাকিস্তানের আ. লীগ প্রেসিডেন্ট নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এতে বিস্মিত হয়ে পড়েন। কারণ তিনি এই বিষয়ে কিছুই জানতেন না। এই ছয় দফা নিয়ে আ. লীগে ভাঙ্গন দেখা দেয়। শুধু তাই নয় যারা সেই মিটিঙে আ. লীগের অন্যান্য নেতা যারা মুজিবের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন তারাও আগে থেকে কিছুই জানতেন না ৬ দফার ব্যাপারে।

দুঃখজনক ও বিস্ময়কর হলেও সত্য মূলত এই ছয় দফার কারিগর ছিলেন আইয়ুব খান। কারণ তিনি চেয়েছিলেন সেনা অফিসার ও রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি তাসখন্দ থেকে অন্যদিকে সরিয়ে দিতে। এবং ৬ দফার বিরোধী হয়ে পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ প্রভাব বজায় রাখতে সবাই যেন তার হাতকেই শক্তিশালী করে। পরিশেষে কিন্তু তাই হয়েছিলো। আইয়ুব ৬ দফাকে হাতিয়ার করে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আইয়ুব তথ্য সচিব আলতাফ গওহরকে দিয়ে ৬ দফা প্রনয়ন করেন। আলতাফ সাহেব কর্মসূচীটি রুহুল কুদ্দুসকে দেন। রুহুল কুদ্দুস ছিলেন মুজিবের ইনার সার্কেল। তিনি সেটা কৃষি ব্যংকের এম ডি খায়রুল বাশারকে দিয়ে টাইপ করিয়ে বিমানে উঠার আগ মুহুর্তে মুজিবের হাতে গুঁজে দেন। [৮, ১০]

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠে এই কারণে যে, আলতাফ গওহর পাকিস্তানের সমস্ত পত্র-পত্রিকাকে নির্দেশ দেন এই মর্মে যেন তারা ৬ দফার বহুল প্রচার করে। এভাবেই ছয় দফা আলোচিত হয়। নতুবা বিরোধীদের মিটিঙে যেই ছয় দফা নিয়ে কোন আলোচনাই হয় নি সেই ছয় দফা নিয়ে মাতামাতি করার কোন কারণ নেই। লাহোরে ৫ তারিখ ৬ দফা উত্থাপন না করতে পেরে মুজিব ১০ ফেব্রুয়ারী সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে পত্রিকাগুলো আরো রসদ পায়। মানুষ ভুলে যায় তাসখন্দ কিংবা কাশ্মীর সমস্যা। রাজনীতিবিদ ও সামরিক অফিসারদের মাথা ব্যাথার কারণ হয় ৬ দফা। [৮,৯]

এদিকে মুজিবের অবস্থাও ভালো নয়। আওয়ামী লীগের অধিকাংশই ৬ দফা মানে নি। দফা গুলোর সাথে তাদের বিরোধ না হলেও তাদের মূল বিরোধ মুজিবকে নিয়ে। মুজিবের কারো সাথে পরামর্শ না করে এহেন ঘোষনা কেউ মেনে নিতে পারে নি। ১৯৬৬ সালের ১৮-১৯ মার্চ ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্তানের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক শুরু হয়। এতে অন্যান্য মেম্বার সহ লীগ সভাপতি আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের প্রবল আপত্তির মুখে মুজিব ছয় দফা পাশ করাতে ব্যর্থ হয়। এর মাধ্যমে ছয় দফার সাথে আ. লীগের আর কোন সম্পর্ক থাকে না। হতাশ মুজিব তার শেষ অস্ত্র ছাত্রলীগকে ব্যবহার করেন। [৭,৮,৯]

এই প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রী ও তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক বলেন। দুঃখভরা মন নিয়ে শেখ মুজিব আমাদের(ছাত্রলীগ) ডাকলেন। বললেন, আমি তো বিপদে পড়ে গেছি। আমারে তোরা কি সাহায্য করবি না? ছয় দফা বলার পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে আমার অপর এটাক আসছে। আমার তো এখন ঘরে বাইরে শত্রু। আমরা তখন বললাম নিশ্চয়ই আপনার পাশে থাকবো। যাই হোক ফ্যসিবাদী মুজিব ছাত্রলীগের গুন্ডাদের সহযোগিতায় সভাপতিকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এবং নিজে পূর্ব পাকিস্তান আ. লীগের সভাপতি হন। ছয় দফার আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যান। [৮]

এভাবেই আইয়ুব-মুজিব ষড়যন্ত্রে নষ্ট হয়ে যায় কাশ্মীরের মুসলমানদের ভাগ্য। হয়তো তখন পাকিস্তানী জেনারেলরা তাসখন্দ চুক্তিকে বাতিল করে ভারতকে চাপ দিয়ে কাশ্মীর অধিকার করে নিতে পারতো।

ড: আনিসুজ্জামান এই প্রসঙ্গে বলেন,
"ছয় দফার প্রণেতা কে, এই নিয়ে অনেক জল্পনা হয়েছিল। কেউ কেউ বলেছিলেন সিভিল সার্ভিসের কয়েকজন সদস্য এটা তৈরি করে শেখ মুজিবকে দিয়েছিলেন, কেউ কেউ সে কৃতিত্ব কিংবা দোষ দিয়েছিলেন কয়েকজন সাংবাদিককে। তাদের পেছনে কোন শক্তি কাজ করছিল, সে বিচারও হয়েছিল। প্রথমে উঠেছিল ভারতের নাম। কিন্তু পাকিস্তান হওয়া অবধি তো দেশের বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল ভারতের প্ররোচনা বলে। পরে বড়ো করে যে নাম উঠলো, তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্ব এবং ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্টের বন্ধুত্বের কারণে পাকিস্তান ভাঙার উদযোগ নিচ্ছে মার্কিনরা, এমন একটা ধারণা খুব প্রচলিত হয়েছিল। আমরা যারা একটু বামঘেঁষা ছিলাম, তারা এই ব্যাখ্যা মেনে নিয়েছিলাম। ফলে, ফেডারেল পদ্ধতি ও স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষপাতী হলেও ছয় দফাকে আমরা তখন গ্রহণ করিনি। আমরা আরো শুনেছিলাম যে, পাকিস্তান ভাঙতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি করতে দেওয়া হবে; সুতরাং এ কাজে মার্কিনদের উৎসাহ তো থাকবেই। যদি প্রশ্ন উঠতো যে, পাকিস্তান তো সেনটো-সিয়াটোর সদস্য, তাহলে জবাব পাওয়া যেতো যে, পাক-ভারত যুদ্ধের পরপ্রেক্ষিতে ওসব জোটের অসারতা প্রমাণ হয়ে গেছে এবং পাকিস্তান যে কোন সময় তার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। পাকিস্তান কখনোই এসব সামরিক জোট ছাড়েনি, তবে আইয়ুব খানের ‘ফ্রেন্ডস নট মাস্টার্সে’র প্রচারিত নীতি কিছুটা এ ধারণাকে পুষ্ট করেছিল।” [১১]

আতাউর রহমান খান (প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী) বলেন,
"(তাসখন্দে) কয়দিন আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ও লালবাহাদুর শাস্ত্রী একটি যুক্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলেন। সিদ্বান্ত হল, শান্তিপূর্ণভাবে উভয় পক্ষ নিজেদের ছোট বড় সমস্যার সমাধান করবে। আশ্চর্যের কথা, যা নিয়ে যুদ্ধ, অর্থাৎ কাশ্মীর, তার নামগন্ধও এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখ রইল না। এত কান্ড করে, এত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে, সারা পাকিস্তানকে প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি ঠেলে দেওয়ার পর সিদ্ধান্ত হল, ওম্ শান্তি।

পশ্চিম পাকিস্তানে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য শহর বাজার গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সেরা সৈনিক নিহত হয়েছেন। পৃথিবীর কোন যুদ্ধে নাকি এত অল্প সময়ে এত অফিসার নিহত হয় নাই। তাদের স্থান পূরণ সম্ভব হবে না। তাই, পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত বিরুপ ছিল। এত ক্ষয়ক্ষতির পর আয়ুব খাঁ সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে অপমান-জনক একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করলেন। দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এই চুক্তি অপরাধ স্বীকৃতির শামিল বলে তারা মনে করে।

যে সব সৈনিক কর্মচারী শহীদ হয়েছেন তাদের বিধবা স্ত্রী ও পরিবারবর্গ এক মিছিল বার করল লাহোর শহরে। ধ্বনি তুলল, আমাদের স্বামী পুত্র ফেরত দাও। তারা শাহাদাত বরণ করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারেন নাই। অনর্থক আপনি তাদের মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছেন। অকারণে তাদের অমূল্য জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। যদি দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য হতো, তা হলে আপনি এমন চুক্তি কেন স্বাক্ষর করলেন? ইত্যাদি –

পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য ফেব্রুয়ারী মাসের পাঁচ-ছয় তারিখে নিখিল পাকিস্তান জাতীয় কনফারেন্স আহ্বান করলেন। এই উপলক্ষে চৌধুরী মহম্মদ আলি ও নবাবজাদা নসরুল্লাহ খাঁ ঢাকা এসে সব দলের সাথে আলাপ আলোচনা করে কনফারেন্সে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ করলেন। বললেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত সঙ্কটজনক এই মূহুর্তে আমাদের কর্তব্য নির্ধারণ করা উচিত।

জামাত, নিজামে ইসলামীও কাউন্সিল লীগ যোগদানে সম্মতি দিল। আওয়ামী লীগেরও দোমনাভাব। শেখ মুজিবের মতামতই দলের মত। প্রতিষ্ঠানের ভিন্ন অভিমত নাই। শেখ মুজিব কনফারেন্সে যোগদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। এন-ডি-এফ সভা করে মত প্রকাশ করল যে, কনফারেন্সের পক্ষে আমাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে, তবে বর্তমান অবস্থায় কোন সদস্য এতে যোগদান করতে পারছেনা। শেখ মুজিব আমাকে টেলিফোনে বললেন, আপনারা ঠিকই করেছেন। আমরাও যাবনা।

পরদিন সংবাদপত্রে দেখি, শেখ মুজিব সদলবলে লাহোর যাচ্ছেন। প্রায় চৌদ্দ পনেরো জন এক দলে। ব্যাপার কি? হঠাৎ মত পরিবর্তন। মতলবটা কি?

লাহোর কনফারেন্স শুরু হল গভীর উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে।

অধিবেশন চলাকালে হঠাৎ একটি বোমা নিক্ষেপ করলেন – ‘ছয় দফা’। প্রস্তাব বা দাবীর আকারে একটা রচনা নকল করে সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হল। কোন বক্তৃতা বা প্রস্তাব নাই, কোন উপলক্ষ নাই, শুধু কাগজ বিতরণ। পড়ে সকলেই স্তম্ভিত হয়ে গেল। জাতীয় কনফারেন্সে এই দাবী নিক্ষেপ করার কি অর্থ হতে পারে? কনফারেন্স ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে সম্মিলিত হয়েছে। এই দাবী যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন, এই সম্মেলন ও এই সময় তার উপযোগী নয় – সম্পূর্ণ অবান্তর। [১২]

তারপর দলবলসহ শেখ মুজিব ঢাকা ফিরে এসে মহাসমারোহে ‘ছয় দফা’ প্রচার করলেন সংবাদপত্রে। শেখ মুজিবের দাবী ও নিজস্ব প্রণীত বলে ছয়-দফার অভিযান শুরু হয়ে গেল।

ছয় দফার জন্মবৃত্তান্ত নিম্নরুপ :
কিছুসংখ্যক চিন্তাশীল লোক দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দূরাবস্থার কথা আলাপ আলোচনা করেন। আমাদের ইঙ্গিত ও ইশারা পেয়ে তারা একটা খসড়া দাবী প্রস্তুত করলেন। তারা রাজনীতিক নয় এবং কোন রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টও নয়। তারা ‘সাত দফার’ একটা খসড়া আমাদের দিলেন। উদ্দেশ্য, এটা স্মারকলিপি হিসাবে আয়ুব খাঁর হাতে দেওয়া, কিংবা জাতীয় পরিষদে প্রস্তাবাকারে পেশ করার ব্যবস্থা করা।

এই খসড়ার নকল বিরোধীদলীয় প্রত্যেক নেতাকেই দেওয়া হয়। শেখ মুজিবকেও দেয়া হয়। খসড়া রচনার শেষ বা সপ্তম দফা আমরাও সমর্থন করি নাই। শেখ মুজিব সেই দফা কেটে দিয়ে ছয়দফা তারই প্রণীত বলে চালায়ে দিল। তারপর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির দ্বারা ছয় দফার দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক ও অর্থনৈতিক মর্ম ও তাৎপর্য লেখায়ে প্রকাশ করা হয়। ইংরেজী ও বাংলায় মুদ্রিত হয়ে পুস্ত্কাকারে প্রচারিত হয় সারা দেশব্যাপী।

লাহোর কনফারেন্স বানচাল হয়ে গেল। নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবকেই এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী করেন। তারা অভিযোগ করেন, শেখ মুজিব সরকার পক্ষ থেকে প্ররোচিত হয়ে এই কর্ম করেছেন। লাহোরে পৌঁছার সাথে সাথে আয়ুব খাঁর একান্ত বশংবদ এক কর্মচারী শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করে কি মন্ত্র তার কানে ঢেলে দেয় যার ফলেই শেখ মুজিব সব উলটপালট করে দেয়। তারা এও বলে যে আওয়ামী লীগের বিরাট বাহিনীর লাহোর যাতায়াতের ব্যয় সরকারের নির্দেশে কোন একটি সংশ্লিষ্ট সংস্থা বহন করে। আল্লাহ আলীমূল গায়েব।” [১২]

বিঃ দ্রঃ অনেকে মনে করেন ছয় দফা বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছিলো। তা মোটেই নয়। কারণ আইয়ুবের পতনের সাথে সাথেই মুজিব ভুলে যায় ছয় দফার কথা। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য নির্বাচনের প্রস্তুতি নেন। ইশতেহারে উল্লেখ করেন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ অখন্ডতা রাখবেন, কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন করবেন না। ছয় দফা তার ৭০ এর নির্বাচনী মেনিফেস্টোতো ছিল না।

দু’দফা জামায়াত নিষিদ্ধঃ 
আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে এবং ১৯৬৪ সালে জামায়াত নিষিদ্ধ করে। ১৯৬৪ সালে গ্রেপ্তার হন এবং সে বছরই মুক্তি পান। সরকারের স্বৈরচারী আচরণের প্রতিবাদ এবং ইসলামী সংবিধানের জন্য চলমান আন্দোলনের জন্য জামায়াতের উপর এই নির্যাতন নেমে আসে। [৬]

আগরতলা ষড়যন্ত্রঃ 
আইয়ুব সরকারকে উৎখাত করার জন্য শেখ মুজিব ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে গোপন বৈঠক করে। এটা সরকারি গোয়েন্দারা আবিষ্কার করে এবং মুজিব সহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে। মুজিবের বিরুদ্ধে জনগণ ক্ষেপে উঠে। মুজিবসহ আওয়ামীলীগ এই বৈঠকের কথা অস্বীকার করে। জনগণ গোড়া থেকেই ভারতবিরোধী। মুজিব এই ধরণের কাজ করতে পারে তা তাদের ধারণার অতীত। বাঙ্গালীরা স্বৈরাচারী আইয়ুবের কথা বিশ্বাস করেনা বিশ্বাস করে আওয়ামী লীগের কথা। আওয়ামীলীগ এই মামলার নাম দেয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবের মুক্তির দাবীতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আন্দোলন শুরু করে। [১৩, ১৪]

অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও স্বৈরাচারী আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থানের। আইয়ুব খান পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ায় সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। ইয়াহিয়া খান এসেই প্রথমে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষনা দেয়। মামলা নিষ্পত্তির চার যুগ পর মামলার আসামী ক্যাপ্টেন এ. শওকত আলী ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি স্বরচিত গ্রন্থে এ মামলাকে সত্য মামলা' বলে দাবী করেন। মজার বিষয় হলো এই দাবীটা তিনি যদি ১৯৬৯ এ করতেন তাহলে আর আওয়ামীলীগের এতদিন পর্যন্ত রাজনীতি করার সৌভাগ্য হতো না। ভারত সংশ্লিষ্টতা কিংবা পাকিস্তান বিরোধী কোন কর্মকান্ড সে সময় জনগণ সহ্য করতো না। এই সমস্যাটা হয়েছে ভাসানীর ক্ষেত্রে। ভাসানী ১৯৭০ এ বাঙ্গালীদের মধ্যে সবচাইতে প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। তিনি নির্বাচন না করে ঘোষনা দিলেন “ভোটের বাক্সে লাথি মার বাংলাদেশ স্বাধীন কর”। বাঙ্গালী জনগণ লাথি ঠিকই মেরেছে তবে ভোটের বাক্সে নয়, ভাসানী এবং তার দল ন্যশনাল আওয়ামী পার্টিকে। ভাসানী হিরো থেকে জিরোতে পরিণত হন। অপরদিকে পাকিস্তানের সংহতির প্রতি আনুগত্য পোষন করে ইশতেহারে কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন করেন মুজিব। মুজিবের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মুজিবকে বিপুল ভোট দেয় বাঙ্গালী জনগণ।

সত্তরের নির্বাচন ও ফলাফলঃ 
ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে ১৯৭০ সনে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সনের অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যার কারণে ডিসেম্বর পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ১৯৭১ এর জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে যায়। নির্বাচনে মোট ২৪ টি দল অংশ নেয়। ৩০০ টি আসনে মোট ১,৯৫৭ জন প্রার্থী অংশগ্রহণ করার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়। এর পর কিছু প্রার্থী তাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে ১,৫৭৯ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করে। আওয়ামী লীগ ১৭০ আসনে প্রার্থী দেয়। এর মধ্যে ১৬২টি আসন পূর্ব পাকিস্তানে এবং অবশিষ্টগুলি পশ্চিম পাকিস্তানে। জামায়াতে ইসলামী দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক প্রার্থী দেয়। তাদের প্রার্থী সংখ্যা ১৫১। পাকিস্তান পিপলস পার্টি মাত্র ১২০ আসনে প্রার্থী দেয়। তার মধ্যে ১০৩ টি ছিল পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে তারা কোন প্রার্থী দেয়নি। পিএমএল (কনভেনশন) ১২৪ আসনে, পিএমএল (কাউন্সিল) ১১৯ আসনে এবং পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাইয়ুম) ১৩৩ আসনে প্রতিদ্বন্দীতা করে।
নির্বাচনে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং প্রায় ৬৫% ভোট পড়েছে বলে সরকার দাবী করে। সর্বমোট ৫৬,৯৪১,৫০০ রেজিস্টার্ড ভোটারের মধ্যে ৩১,২১১,২২০ জন পূর্ব পাকিস্তানের এবং ২৩,৭৩০,২৮০ জন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভোটার। [১৫]

ন্যশনাল এ্যাসেম্বলীতে আওয়ামী লীগ ১৬০ টি আসনে জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সাধারণ নির্বাচনের একই সাথে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান এ্যাসেম্বলীর ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের ৮১টিতে জয়লাভ করে। [১৫]

আওয়ামী লীগ ৩৮.৩% ভোট এবং আসন ১৬০
পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯.৫% ভোট এবং আসন ৮১
পিএমএল (কাইয়ুম) ৪.৫% ভোট এবং আসন ৯
পিএমএল (কনভেনশন) ৩.৩% ভোট এবং আসন ৭
জমিয়ত উলেমা -ই- ইসলাম ৪.০% ভোট এবং আসন ৭
মারকাজি জমিয়তন-উলেমা-পাকিস্তান ৪.০% ভোট এবং আসন ৭
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালি) ২.৩% ভোট এবং আসন ৬
জামায়াত-ই-ইসলামী ৬.০% ভোট এবং আসন ৪
পিএমএল (কাউন্সিল) ৬.০% ভোট এবং আসন ২
পিডিপি ২.৯% ভোট এবং আসন ১
স্বতন্ত্র ৭.১% ভোট এবং আসন ১৬ 


১৯৭১ সাল হতে পারতো পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। কারণ এই প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যদিও এই নির্বাচন সামরিক শাসনের অধীনে হয়েছে তারপরও এই নির্বাচন নিয়ে কোন পক্ষেরই অভিযোগ ছিল না। সুষ্ঠু নির্বাচন সবাই মেনে নেন। সংবিধান অনুযায়ী বৈধ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন আওয়ামীলীগের শেখ মুজিব। ইয়াহিয়া খান সেভাবেই প্রস্তুত হচ্ছিলেন। কিন্তু বাধ সাধে ভুট্টো। সে প্রশ্ন তোলে নৈতিকতার। কারণ পাঁচটি প্রদেশের মধ্যে একটি প্রদেশ ছাড়া বাকী চারটিতে কোন সমর্থনই পায়নি আওয়ামীলীগ। শুধু একটি প্রদেশের ভোট দিয়ে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সমীচীন নয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উভয়পক্ষকে আলোচনার প্রস্তাব দেন। মুজিব আলোচনা প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন কারো যদি আলোচনা করতে হয় সে যেন ঢাকায় এসে আলোচনা করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। পার্লামেন্ট অধিবেশন স্থগিত করেন এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করেন।

ষড়যন্ত্র শুরু হয় ১৯৬২ সাল থেকেঃ 
রুশপন্থী বামেরা একটা সফল বিপ্লবের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল যেখানে তাদের আদর্শ তারা বাস্তবায়ন করবে। এদিকে র’ গঠিত হওয়ার পর তাদের ১ম প্রজেক্ট হলো পাকিস্তান আলাদা করা। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের মধ্যে একটি গোপন সংগঠন সৃষ্টি হয় যার নাম নিউক্লিয়াস। র’ এর পক্ষ থেকে চিত্তরঞ্জন, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সিরাজুল আলম খানের সমন্বয়ে এই আন্দোলন অত্যন্ত গোপনে চলতে থাকে। ছাত্রলীগের মধ্যে যারা সমাজতন্ত্রের পক্ষে তাদের আস্তে আস্তে গোপন সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরাই মূলত বাংলাদেশ নাম ঠিক করে, পতাকা ঠিক করে, সংগীত ঠিক করে ১৯৬৮ সালে। [১৬, ১৭]

অপরদিকে মাওবাদীরা মানে চীনপন্থী বামেরাও এমন একটি রাষ্ট্রের স্বপন দেখতো তবে তাদের গুরুদের কাজ থেকে আশা না পাওয়ায় তারা একটু পিছিয়ে থাকে। ভাসানী নিউক্লিয়াস সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু চীন পাকিস্তানের কৌশলগত মিত্র হওয়ায় ভাসানীর বহিঃবিশ্বের সাপোর্ট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও সে তার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে স্বাধীনতার ঘোষনা দিয়ে দেয়। এই ঘোষনাই তার রাজনৈতিক ক্যরিয়ার শেষ করে দেয়। কারণ এদেশের পাঁচ শতাংশ মানুষও এমনকি ভাসানীর দল ন্যাপ যারা করে তারাও স্বাধীনতার পক্ষে ছিল না। [১৭]

র’ আর নিউক্লিয়াসের লোকজন গোপনে স্বাধীনতার প্রস্তুতি নিতে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন ছিল কোন একটা গন্ডগোলের উসিলায় দেশে যুদ্ধ লাগিয়ে দেয়া। বাকী কাজ ভারত করবে। এটা ছাড়া তাদের একজন নেতাও দরকার ছিল। তারা মুজিবকে নানানভাবে প্ররোচিত করেন। মুজিব তাদের প্ররোচনায় কান দেন নি। আসলে কান দেয়ার কোন প্রয়োজনই মুজিবের পড়েনি। মুজিব যেখানে পুরো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখে সেখানে কেন সে শুধু শুধু দেশ ভাগ করে একটা ছোট দেশের প্রধানমন্ত্রী হবে? আবার ভাগ হয়ে গেলে সেই দেশটা ভারতের পেটের ভেতর ঢুকে যাবে! আ স ম রব সহ ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থী নেতারা ৭১ এর ২ মার্চ বাংলাদেশের পতাকা মুজিবের বাড়ির সামনে উত্তোলন করেন। মুজিব অত্যন্ত রাগান্বিত হন এবং নিজেই পতাকা ছিড়ে ফেলেন। তারপরও থেকে থাকে নি তারা, গনহত্যা চালাতে শুরু করে। [১৬]

৩ ও ৪ মার্চ চট্টগ্রামের ফিরোজ শাহ কলোনীতে ও ওয়্যারলেস কলোনীতে প্রায় ৭০০ অবাঙ্গালীদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। এখানে বসবাসকারী বহু শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়। সে সময় সরকারি হিসেবে ৩০০ লাশ দাফন করা হয়। [১৮, ১৭, ১৯ ২০, ২১]

দ্যা টাইমস অফ লন্ডন ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল রিপোর্ট করেছিলো, হাজার হাজার সহায় সম্বলহীন মুসলিম উদ্বাস্তু যারা ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে এসে আশ্রয় গ্রহন করে তারা গত সপ্তাহে বিক্ষুব্ধ বাঙ্গালীদের দ্বারা ধ্বংসাত্মক আক্রমনের শিকার হয়। বিহারী মুসলিম উদ্বাস্তু যারা সীমানা পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করে এবং ভারতে প্রবেশকারী একজন বৃটিশ টেকনিশিয়ান এই খবর নিশ্চিত করেন। উত্তর পূর্ব শহর দিনাজপুরে শত শত অবাঙ্গালী মুসলিম মারা গিয়েছে। [১৭, ২২]

খুলনায় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে ৪ মার্চ কয়েকজনকে হত্যা করা হয়, ৫ মার্চ খালিশপুর ও দৌলতপুরে ৫৭ জনকে অবাঙ্গালীকে ছোরা দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সামরিক বাহিনীর কঠোর সমালোচক সাংবাদিক মাসকারেনহাসও স্বীকার করেছেন অবাঙ্গালীদের এই অসহায়ত্বের কথা। অবাঙ্গালীদের জান মাল রক্ষায় শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে বাহ্যত নির্দেশ থাকলেও কোন কার্যকর উদ্যোগ ছিলনা। আওয়ামীলীগের কর্মীরা অদৃশ্য ইঙ্গিতে হত্যা খুন লুটতরাজ করে যাচ্ছিল অবারিতভাবে। সারাদেশেই চলছিল নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। সেই হিসেবে ঢাকা অনেক ভালো ছিল। [১৭, ২৩, ২২]

ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসসহ অনেক দূতাবাসে হামলা চালায় বিদ্রোহীরা। ১২ মার্চ ও ১৫ মার্চ মার্কিন কনসুলেট লক্ষ্য করে বোমা হামলা ও গুলি করা হয়। ১৯ মার্চ হোটেল ইন্টারকন্টিনালে বোমা হামলা ও গুলি করে বিদ্রোহীরা। এগুলো ছিল শান্তি আলোচনার জন্য বড় অন্তরায়। তারপরও বলা চলে ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিব আলোচনা ফলপ্রসুই হতে যাচ্ছিল। পরিস্থিতির উপর মুজিবসহ কারোই নিয়ন্ত্রণে ছিলনা। সেনাবাহিনীও সরকারি আদেশের বাইরে কোন জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছিল না। [১৭, ২৩]

আর এদিকে RAW, এদেশীয় বাম ও আওয়ামীলীগে ঘাপটি মেরে থাকা সমাজতন্ত্রবাদীরা এদেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিবের আলোচনাকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য একের পর এক অবাঙ্গালী গণহত্যা চালিয়েছে, সারা দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অনেক বিহারীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে বিশেষ করে জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। [১৭, ২২]

সারাদেশে সেনাবাহিনীর উপর বিনা উস্কানীতে আক্রমন করেছিলো বাঙ্গালীদের একটা অংশ। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে জয়দেবপুরে। গাজিপুরে সমরাস্ত্র কারখানার নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে একদল সৈন্য সেখানে পৌঁছানোর আগে আওয়ামীলীগ কর্মীরা জয়দেবপুরে ব্যরিকেড সৃষ্টি করে। ব্যরিকেডের জন্য তারা একটি ট্রেনের বগি ব্যবহার করে। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জাহানজেবের নেতৃত্বে সৈন্যদল। তারা ব্যরিকেড সরিয়ে সেখানে পৌঁছায়। নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখে জাহানজেব আরবাব আবার যখন হেডকোয়ার্টারে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন বিশৃংখলাকারীরা সৈন্যদলকে আবারো ঘিরে ফেলে। বন্দুক, শর্টগান, লাঠি, বোমা ইত্যাদি নিয়ে হামলা চালায়। জাহানজেব বাঙ্গালী অফিসার লে. ক. মাসুদকে গুলি চালাতে নির্দেশ দিলেন। মাসুদ ইতস্তত করলে অপর বাঙ্গালী অফিসার মঈন তার সৈন্যদের নিয়ে পাল্টা আক্রমন চালালে কিছু মানুষ নিহত হয় বাকীরা পালিয়ে যায়। মাসুদকে পরে ঢাকায় এসে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় আরেক বাঙ্গালী অফিসার কে এম সফিউল্লাহকে। [১৭, ২৩] 

এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ১৯ মার্চ সকাল দশটায় তার ইউনিটকে জানানো হয় ব্রিগেড কমান্ডার মধ্যহ্নভোজে আসছেন এবং নিকটবর্তী গাজিপুর সমরাস্ত্র কারখানা পরিদর্শন করবেন। কিন্তু জনতা প্রায় ৫০০ ব্যরিকেড বসিয়ে সৈন্যদের আটকে দেয়। এগুলো সরিয়ে তারা আসলেও ফিরে যাওয়ার সময় জয়দেবপুরে মজবুত ব্যরিকেড সৃষ্টি করলে লে. ক. মাসুদ তাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। এমন সময় দুজন বাঙ্গালী সৈনিক জাহানজেবকে জানায় তাদেরকে বেধড়ক পিটিয়েছে, অস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়েছে। এবার জাহানজেব গুলি করার নির্দেশ দিলে মঈন তার সৈন্যদের গুলি করতে বলে। তবে বাংলায় বলে দেয় ফাঁকা গুলি করার জন্য। এরপরও পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রনে না এলে এবার জাহানজেব কার্যকরভাবে গুলি করার নির্দেশ দেন। তারাও পাল্টা গুলি ছোঁড়ে। দু’জন নিহত হয়। সফিউল্লাহ আরো জানান, গাজিপুরের পরিস্থিতিও ছিল উত্তেজনাকর। রাস্তায় ব্যরিকেড দেয়া হয়েছিল। সমরাস্ত্র কারখানার আবাসিক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার করিমুল্লাকে আটকে ফেলে বাঙ্গালীরা। আবাসিক পরিচালককে উদ্ধার করতে আমরা সেনা প্রেরণ করেছিলাম। [২৩]

এভাবে সারাদেশে সেনাবাহিনীকে নানাভাবে উস্কে দিয়ে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি করেছিলো বাঙ্গালীদের একটা অংশ। ইয়াহিয়া বিদ্রোহ দমন করার জন্য টিক্কা খানকে এদেশে আনলেও সেনাবাহিনীকে শুধুমাত্র আক্রান্ত হওয়া ছাড়া কোন ভূমিকা নিতে বারণ করেন। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই ধৈর্য্যের প্রশংসা করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক সাংবাদিক মাসকারেনহাস। এসব ঘটনায় মুজিব বেশ চাপ পড়েছিলেন। সমঝোতাও পড়েছিলো হুমকির মুখে। তারপরও হয়তো সমঝোতা হত। কিন্তু একটা ছবি যা বিদেশী পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো এরপর আর কোন আলোচনাতে অংশ নিতে রাজি হয়নি ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো। সেটি ছিল ঢাকা ভার্সিটি এলাকায় যুবক ছেলে মেয়েদের যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে মার্চপাস্টের ছবি। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো একথা মনে করেই নিয়েছেন আলোচনার নামে সময়ক্ষেপন করে মূলত মুজিব ভারতীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকান্ডের জন্য ও আটক বিহারীদের উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল সমূহে অভিযান চালায়। এসময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা খালি করে দেয়ার জন্য বলেন। সকল ছাত্র এবং শিক্ষক হল ছেড়ে দিলেও কয়েকজন শিক্ষক ও প্রায় পঞ্চাশজনের মত ছাত্র র’ ইঙ্গিতে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় না ছেড়ে সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। বিদ্রোহী ছাত্রদের চেষ্টা ছিল বালির বাঁধের মত। সেদিন হলে যারা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে চেয়েছিলো তাদের সবাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনী। এটাই অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। এবং এটা খুবই যৌক্তিক অপারেশন ছিল। তবে সবাইকে হত্যা না করে গ্রেপ্তার করতে পারলে পাকিস্তান সরকার হয়তো সেসময় পরিস্থিতি ভালোভাবে সামাল দিতে পারতো। [১৭]

এতক্ষন পর্যন্ত যত ঘটনা ঘটেছে তাতে কোনভাবেই দেশ ভাগ হওয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি। এদেশের মানুষ পাকিস্তান সেনাশাসনের প্রতিবাদ করেছে। গণতন্ত্র চেয়েছে কিন্তু দেশভাগ কেউই চায়নি। এর পরদিনই জিয়াউর রহমান নিজ সিদ্ধান্তে ক্যু করেন। ওসমানী তার এই ক্যু কে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি কিছু রাজনৈতিক লোকদের একত্র করে ১৭ এপ্রিল আবার ক্যু করেন এবং স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষনাপত্র পাঠ করেন অতঃপর ভারত গমন করেন। জয় হয় ভারতীয় ষড়যন্ত্রের। জামায়াত সেসময় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আন্দোলন করে এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার পক্ষে অবস্থান নেয়। জামায়াতের এই অবস্থান ছিল এদেশের অধিকাংশ মানুষের অবস্থান। আওয়ামীলীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন। স্বাধীনতা এদেশের মানুষের দাবী ছিল না। [১৭]

কথিত স্বাধীনতার নামে ভারতের গোলামী চেয়েছিলেন এদেশের কিছু সমাজতন্ত্রী মানুষেরা আর কিছু উচ্চবিলাসী সেনা কর্মকর্তা। জামায়াত সেসময় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে অবস্থান নিয়েছে কোন সশস্ত্র গ্রুপ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেনি। জামায়াত যুদ্ধ বন্ধে কয়েকবার চেষ্টা করেছিল, শান্তি আনার চেষ্টা করেছিল, সরকার এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে সমজোতার চেষ্টা করেছিল কিন্তু দু-পক্ষের বাড়াবাড়িতে সেটা সম্ভব হয়নি। হত্যা খুন ধর্ষন উভয় পক্ষ করেছে। জামায়াত উভয়পক্ষের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেছে আর বিচ্ছন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছে যারা ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। [২৪]

১- ইসলামী বিপ্লবের পথ/ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী
২- মাওলানা মওদুদী/ একটি জীবন একটি ইতিহাস
৩- The History of Urdu Language
৪- ভাষা আন্দোলন, বাংলা পিডিয়া
৫- কাদিয়ানী সমস্যা/ সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদী
৬- মাওঃ মওদুদী, একটি জীবন একটি ইতিহাস/ আব্বাস আলী খান
৭- ছয় দফা থেকে বাংলাদেশ/ রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী
৮-  বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ, প্রামান্য চিত্র।
৯- বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে 'র' ও সিআইএর ভূমিকা/ মাসুদুল হক।
১০- আব্দুল মালেক উকিলের সাক্ষাতকার, সাপ্তাহিক মেঘনা, ১৯৮৫ সালের ১৬ই ডিসেম্বর
১১- কাল নিরবধি/ ড: আনিসুজ্জামান
১২- স্বৈরাচারের দশ বছর/ আতাউর রহমান খান
১৩- বাংলাদেশে র/ আবু রুশদ
১৪- সত্য মামলা আগরতলা/ কর্ণেল শওকত আলী (অবঃ)
১৫- The last days of United Pakistan/ G.W.Choudhury
১৬- দুঃসময়ের কথাচিত্র সরাসরি/ ড. মাহবুবুল্লাহ ও আফতাব আহমেদ
১৭- বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধঃ বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ, এম আই হোসেন।
১৮- দ্যা ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ, আর্চার ব্লাড
১৯- The 1971 Indo-Pak war, A soldier's Narrative, Hakim Arshad Koreshi
২০- The Crisis in East Pakistan, Govt of Pakistan, 5 August, 1971.
২১- Anatomy Of Violence, Sarmila Bose
২২-The event in East Pakistan, 1971- International Commission of Jurists, Geneva.
২৩- ডেড রেকনিং, শর্মিলা বসু
২৪- পলাশী থেকে বাংলাদেশ/ অধ্যাপক গোলাম আযম

বুধবার, ২৯ জুন, ২০১৬

আকিমুস সালাহ বলতে আসলে কী বুঝায়?


‘কায়েম করা’ কথাটির অর্থ হচ্ছে, প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বারংবার নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কুরআনে নানানভাবে নামাজের কথা এসেছে প্রায় ১০৪ বার এবং প্রায় ১৮ বার আল্লাহ তায়ালা আদেশ সূচকভাবে নামাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। নামাজ কায়েম বলতে আমরা সাধারণত নামাজের অনুষ্ঠান বাস্তবায়নকে বুঝি। অর্থাৎ আমরা সাধারণত যা বুঝি নিজে নামাজ পড়া অন্যদেরকে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করাই হচ্ছে আকিমুস সালাহ বা নামাজ কায়েম। আসলে আকিমুস সালাহ বলতে কী বুঝায় তা আমরা আজ আলোচনা করার চেষ্টা করবো। 

নামায প্রতিষ্ঠা দুই ধরণের হতে পারে 
১- ব্যক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠা 
২- সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠা 

ব্যক্তির মধ্যে নামায প্রতিষ্ঠা আবার দুই ধরণের হতে পারে 
ক- নামাজকে ব্যক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা
আমরা অনেকেই স্মার্ট ফোন ইউজ করি। আপনারা জানেন এসব স্মার্ট ফোনে কিছু এপস বা কিছু প্রোগ্রাম প্রথম থেকেই ইন্সটল করা থাকে আবার কিছু প্রোগ্রাম পরবর্তীতে আমাদের প্রয়োজন অনুসারে ইন্সটল করি। ঠিক তেমনি আল্লাহ তায়ালা আমাদের দেহে কিছু প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার বা এপস শুরু থেকেই ইন্সটল করে দিয়েছেন। যেমন আমরা নিঃশ্বাস নেই, ক্ষুদা লাগলে খাই, ক্লান্তি লাগলে ঘুমাই ইত্যাদি। এরপর আমরা যখন আস্তে আস্তে বড় হই তখন কিছু কিছু ব্যাপার আমরা নিজেরা নিজেদের খুশিমত ইন্সটল করে নিই যেমন কেউ গান শোনা ছাড়া থাকতে পারি না, কেউ গল্পের বই পড়তে পড়তে প্রচুর সময় ব্যয় করি, কেউ প্রচুর খেলাধুলা করি, কেউ প্রচুর টিভি দেখি ইত্যাদি। আমরা যারা যেগুলো ইন্সটল করে নিয়েছি সেগুলো ছাড়া আমরা অস্থির হয়ে পড়ি। কোন কারণে টিভি না দেখলে বা না গান শুনলে বা না বই পড়লে আমাদের কাছে সব এলোমেলো লাগে। এটাই হচ্ছে আপনি বা আমি এই বিষয়গুলোকে নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছি। ঠিক তেমনি নামাজও এইভাবে প্রতিষ্ঠিত করার বিষয় আছে। কেউ যদি নামাযকে তার নিজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করে নেয় তখন নামাজের সময় হওয়া মাত্রই সে অস্থির হয়ে পড়বে। নামায পড়ার জন্য তার মন আনচান করবে। তাদের অন্তর থাকবে মসজিদের সাথে লাগোয়া। 

আল্লাহর রাসূল সঃ বলেছেন, আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সঃ বলেছেন যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দিবেন। এর মধ্যে এক ধরণের ব্যক্তি যার ক্বলব মসজিদের সাথে লেগে রয়েছে। 
সহীহ বুখারীঃ ৬২৭ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন) 

নামাজকে নিজের মধ্যে ইন্সটল বা প্রতিষ্ঠা করার পদ্ধতি হচ্ছে বার বার নামাজ পড়া। নামাজের প্রতি সচেতন থাকা। নামাজ না পড়ার শাস্তি এবং আল্লাহর অবাধ্য হওয়ার শাস্তি স্মরণ করা। এভাবে নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে নামাজ আমাদের শরীরে এবং ক্বলবে প্রতিষ্ঠিত হবে। ইনশাআল্লাহ্‌। 

খ- নামাজের শিক্ষাকে ব্যক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা 
শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক নামাজ আদায় করলেই নামাজ কায়েমের হক আদায় হয় না। বরং নামাজ থেকে শিক্ষাগ্রহন করে সেই শিক্ষা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত করাও নামাজ কায়েম তথা নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই ব্যাপারে রাসূল সঃ এর একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে, আবু হুরায়রা রা. বলেন, একদা জনৈক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, অমুক মহিলা নামাজ ও যাকাতে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তবে সে নিজের মুখ দ্বারা তার প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। তিনি বললেন, সে জাহান্নামী। লোকটি আবার বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ, অমুক মহিলা সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে যে, সে কম (নফল) রোজা রাখে, কম (নফল) সদকা করে এবং নামাজও (নফল) কম পড়ে। তার দানের পরিমাণ হলো পনিরের টুকরাবিশেষ। কিন্তু সে নিজের মুখ দ্বারা প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রাসূল সা. বললেন, সে জান্নাতী।
(আহমাদ ও বায়হাকী, শো’আবুল ঈমান)

এই হাদীস থেকে যে বিষয়টা স্পষ্ট হয়েছে তা হলো নামাজ নিয়মিত পড়েও যদি কোন ব্যক্তি নামাজের শিক্ষাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে না পারেন, নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন তাহলে তিনি নামাজ কায়েম করতে পারেন নি। তার নামাজ পড়া কোন কাজে আসবে না। তাই আমাদের নামাজ আদায়ের সাথে সাথে নিজের জীবনে নামাজের শিক্ষা কায়েম করা একান্ত কর্তব্য। এটি আকিমুস সালাহর অংশ। 

আসুন আমরা নামাজ থেকে যে শিক্ষাগুলো পাই সেগুলো নিয়ে আলোচনা করি। 
১. সকল কাজে আল্লাহকে স্মরণ করা। 
সূরা ত্বোয়াহ’র ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে সালাত কায়েম কর। আমরা যে কাজই করি না কেন আমরা অবশ্যই সবসময় আল্লাহকে স্মরণ করবো। প্রতিটা কাজ করার পূর্বে চিন্তা করবো আল্লাহ আমাকে দেখছেন, এই কাজের জন্য আমাকে জবাবাদিহি করতে হবে। এভাবে আল্লাহকে স্মরণ করে যদি আমরা চলতে পারি তাহলে আমাদের দ্বারা পাপ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটাই নামাজের শিক্ষা। 

২. আল্লাহর আদেশ মানার মানসিকতা সৃষ্টি করা
সূরা বাকারার ১৭৭ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, তোমরা মুখ পূর্ব দিক করলে না পশ্চিম দিক করলে, এটি কোন সওয়াব বা কল্যাণের কাজ নয়। বরং সওয়াব বা কল্যাণের কাজ সে-ই করে, যে আল্লাহ, পরকাল, ফেরেশতা, কিতাব ও নবীদের বিশ্বাস করে বা মান্য করে। আর শুধু আল্লাহর ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তাঁর ধনসম্পদকে আত্মীয়-স্বজন, মিসকিন, পথিক, সাহায্যপ্রার্থী ও ক্রীতদাস মুক্তির জন্যে ব্যয় করে এবং নামাজ কায়েম করে, জাকাত আদায় করে, ওয়াদা করলে তা পূরণ করে, দারিদ্র্য, বিপদ-আপদ ও হক বাতিলের দ্বন্দ্বের সময় ধৈর্য ধারণ করে। এরাই (ঈমানের ব্যাপারে) সত্যবাদী এবং এরাই মুত্তাকী।
এখানে আল্লাহ তায়ালা নামাজে আমরা কোনদিক ফিরে দাঁড়াবো সেই প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলেছেন, মূল কথা হলো আল্লাহ যা বলেছেন তা করা এবং যা নিষেধ করেছেন তা থেকে দূরে থাকা। একজন মু’মিনের কাজের মানদণ্ড হবে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সঃ। তাদের কথার বা আদেশের বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। 

৩. আল্লাহর আদেশ-নিষেধ আল-কুরআন থেকে জানার মানসিকতা তৈরি করা: নামাজে কুরআন পড়তে হয় যা থেকে আমাদের জন্য শিক্ষা হলো আমাদের আদেশ নিষেধ জানা তথা জ্ঞানের উৎস হলো আল কুরআন। 

৪. সতর ঢাকা বা পর্দার শিক্ষা 
নামাজে সতর ঢাকা পূর্বশর্ত। এর মাধ্যমে আমাদের পর্দা শেখানো হয়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের বিধান অত্যন্ত যৌক্তিক ও উপকারী। শরীয়ত বিশেষ কোনো পোশাক সুনির্দিষ্ট করে দেয়নি এবং কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইন বা আকৃতিও বলে দেয়নি যে, এ ধরনের পোশাকই তোমাদের পরতে হবে; বরং বিভিন্ন দেশ, অঞ্চল, আবহাওয়া ও মৌসুম ভেদে পোশাক পরিধানের স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে কিছু মৌলিক নীতি ও সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, এ ধরনের পোশাক গ্রহণীয় ও এ ধরনের পোশাক বর্জনীয়।

এক. পোশাক এমন আঁটসাঁট ও ছোট মাপের হতে পারবে না, যা পরলে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকে এবং দৈহিক গঠন ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।

আবু ইয়াযীদ মুযানী রাহ. বলেন, হযরত ওমর রা. মহিলাদেরকে কাবাতী (মিসরে প্রস্ত্ততকৃত এক ধরনের সাদা কাপড়) পরতে নিষেধ করতেন। লোকেরা বলল, এই কাপড়ে তো ত্বক দেখা যায় না। তিনি বললেন, ত্বক দেখা না গেলেও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ফুটে ওঠে।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৫২৮৮

দুই. পোশাক এমন পাতলা ও মিহি হতে পারবে না যাতে শরীর দেখা যায় এবং সতর প্রকাশ পেয়ে যায়। যেমন পাতলা সুতির কাপড়, নেটের কাপড় ইত্যাদি। অবশ্য পাতলা কাপড়ের নিচে সেমিজ জাতীয় কিছু ব্যবহার করলে তা জায়েয হবে। হযরত আলকামা ইবনে আবু আলকামা তার মা থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার হাফসা বিনতে আবদুর রহমান তার ফুফু উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর নিকটে এল। তখন তার পরনে ছিল একটি পাতলা ওড়না। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং একটি মোটা ওড়না পরিয়ে দিলেন।-মুয়াত্তা মালেক ২/৯১৩, হাদীস : ৬

তিন. পোশাকের ক্ষেত্রে কাফের-মুশরিক ও ফাসেক লোকদের অনুসরণ-অনুকরণ ও সাদৃশ্য অবলম্বন করা যাবে না। বিশেষত সেইসব পোশাকের ক্ষেত্রে যা অমুসলিমদের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে‘উসফুর’ (ছোট ধরনের লাল বর্ণের ফুল গাছ) দ্বারা রাঙানো দুটি কাপড় পরতে দেখে বললেন,‘এগুলো হচ্ছে কাফিরদের পোশাক। অতএব তুমি তা পরিধান করো না।’-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৭৭; নাসায়ী, হাদীস : ৫৩১৬

তাছাড়া অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-যে ব্যক্তি অন্য কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদেরই দলভুক্ত। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০২৭

চার. পোশাকের মাধ্যমে অহংকার ও লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ উদ্দেশ্য হওয়া যাবে না। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-যে ব্যক্তি দুনিয়াতে সুখ্যাতি ও প্রদর্শনীর পোশাক পরবে আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তাকে লাঞ্ছনার পোশাক পরাবেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬২৪৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০২৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন- যে ব্যক্তি অহংকারবশত মাটিতে কাপড় টেনে টেনে চলে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দিকে দৃষ্টিপাত করবেন না।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৮৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৮৭

পাঁচ. পুরুষদের জন্য মেয়েলী পোশাক এবং নারীদের জন্য পুরুষদের পোশাক পরা এবং একে অন্যের সাদৃশ্য গ্রহণ করা নিষেধ। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই সব পুরুষের উপর লানত করেছেন, যারা নারীদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে (তাদের মতো আকৃতি, তাদের পোশাক ও তাদের চাল-চলন গ্রহণ করে)। আর সেই সব নারীর উপরও লানত করেছেন, যারা পুরুষের সাদৃশ্য গ্রহণ করে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৮৮৫

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নারীর পোশাক পরিধানকারী পুরুষকে এবং পুরুষের পোশাক পরিধানকারিনী নারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লানত করেছেন।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০৯২

ছয়. পোশাক-পরিচ্ছদের ক্ষেত্রে অপচয় ও অপব্যয় করা, বিলাসিতা করার জন্য বা শখের বশে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পোশাক ক্রয় করা অথবা মাত্রাতিরিক্ত উচ্চমূল্যের পোশাক ক্রয় করা নিষেধ।

হযরত আমর ইবনে শুআইব তার পিতা থেকে, তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা খাও, পান কর, অন্যদের দান কর এবং কাপড় পরিধান কর যে পর্যন্ত অপচয় ও অহংকার করা না হয়।-সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ২৫৫৯; ইবনে মাজাহ,হাদীস : ৩১০৫

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, যা মনে চায় খাও, যা মনে চায় পরিধান কর যে পর্যন্ত দুটি বিষয় না থাকে : অপচয় ও অহংকার।-সহীহ বুখারী ১০/১৫২

সাত. গায়রে মাহরাম ও পর পুরুষের সামনে অলংকার ও পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশ করা যাবে না, যাতে তারা সেদিকে আকৃষ্ট হয়।

ولا يبدين زينتهن الا ما ظهر منها

তারা যেন নিজেদের ভূষণ প্রকাশ না করে।

উক্ত আয়াতে নারীদেরকে হুকুম করা হয়েছে তারা যেন গায়রে মাহরাম বা পর পুরুষের সামনে নিজেদের পুরো শরীর বড় চাদর বা বোরকা দ্বারা আবৃত করে রাখে। যাতে তারা সাজ-সজ্জার অঙ্গসমূহ দেখতে না পায়।

ইমাম যাহাবী রাহ. বলেন, যে সব কর্ম নারীর উপর লানত করে তা হল অলংকার ও আকর্ষণীয় পোশাকের সৌন্দর্য প্রকাশ করা। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় সুগন্ধি ব্যবহার ...। আলকাবায়ের পৃ. ১০২

وقرن فى بيوتكن ولا تبرجن تبرج الجاهلية الاولى

নিজ গৃহে অবস্থান কর সাজ-সজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না। যেমন প্রাচীন জাহেলী যুগে প্রদর্শন করা হত।

প্রাচীন জাহেলী যুগে নারীরা নির্লজ্জ সাজ-সজ্জার সাথে নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াত। আজকের নব্য জাহেলিয়াতের অশ্লীলতা এতটাই উগ্র যে, তার সামনে প্রাচীন জাহেলিয়াত ম্লান হয়ে গেছে।

আট. পুরুষের জন্য টাখনুর নীচে ঝুলিয়ে কাপড় নিষেধ এবং তা কবীর গুনাহ।

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কাপড়ের যে অংশ টাখনুর নীচে যাবে তা (টাখনুর নীচের অংশ) জাহান্নামে জ্বলবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭৮৭

হযরত আবু হুবাইব ইবনে মুগাফফাল গিফারী রা. মুহাম্মাদ কুরাশীকে লুঙ্গি টেনে চলতে দেখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন-আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে অহংকারবশত পায়ের নীচে কাপড় ফেলে চলবে সে জাহান্নামে গিয়ে এভাবে চলবে।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৫৫৪২

৫. সময়ানুবর্তিতা শিক্ষা 
নামায সময়মত পড়তে হয়। সময়মত না পড়লে নামাজ হয় না। এই ব্যাপারে সূরা মাউনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ঐসব মুসল্লিদের জন্য ধ্বংস যারা তাদের নামাজের (সময়ের) ব্যাপারে গাফেল। এই সময়ানুবর্তিতার ব্যাপারে শুধু নামাজে নয় নামাজের বাহিরেও সকল কাজে সচেতন থাকা নামাজের শিক্ষা। 

৬. শরীর সুস্থ ও সবল রাখার শিক্ষা
আল্লাহ তায়ালা সূরা মায়েদায় বলেন, হে মুমিনগণ, যখন তোমরা সালাতে দণ্ডায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসেহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা (ধৌত কর)। আর যদি তোমরা অপবিত্র থাক, তবে ভালোভাবে পবিত্র হও। আর যদি অসুস্থ হও কিংবা সফরে থাক অথবা যদি তোমাদের কেউ পায়খানা থেকে আসে অথবা তোমরা যদি স্ত্রী সহবাস কর অতঃপর পানি না পাও, তবে পবিত্র মাটি দ্বারা তায়াম্মুম কর। সুতরাং তোমাদের মুখ ও হাত তা দ্বারা মাসেহ কর। (নামাজের আগে ওজু গোসল করার শর্ত আরোপের দ্বারা) তোমাদের অহেতুক অসুবিধায় ফেলা (কষ্ট দেয়া) আল্লাহর ইচ্ছা নয়, বরং এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন (পবিত্র) করতে চান (বা করার শিক্ষা দিতে চান) এবং তোমাদের জন্যে তাঁর নেয়ামত (কল্যাণ কামনা) পরিপূর্ণ করে দিতে চান, যাতে তোমরা (কল্যাণপ্রাপ্ত ও খুশি হয়ে) তাঁর গুণগান করতে পার। (মায়েদাহ : ০৬)

ক. নামাজের আগে শরীর, কাপড় ও জায়গা পাক তথা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার শর্তের মাধ্যমে মহান আল্লাহ মানুষকে তাদের শরীর, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশকে ঘন ঘন ধোয়া-মোছার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার শিক্ষা দিয়েছেন। আর এভাবে তিনি তাদের নানা ধরনের রোগের হাত থেকে মুক্ত থাকার এক সুন্দর ব্যবস্থা করেছেন।

খ. ব্যায়াম করা ও ব্যায়ামে কী কী অঙ্গভঙ্গি করতে হবে তা শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে রোগমুক্ত রাখার ব্যবস্থা

গ. মেসওয়াক করার মাধ্যমে শরীর সুস্থ রাখার শিক্ষা। পাঁচবার ওজুর সময় কেউ যদি নিয়মিত মেসওয়াক করে তার দাঁত ও মুখের রোগ অনেক কম হবে।

নামাজকে সমাজে প্রতিষ্ঠা: সমাজে নামাজকে প্রতিষ্ঠা দুইভাবে হতে পারে 

ক- ফরজ নামাজ জামায়াতের সাথে পড়ে নামাজের অনুষ্ঠানকে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করা। 
নামাজের অনুষ্ঠানটির আরকান-আহকামসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মানুষকে শিক্ষা দিয়ে, মসজিদ নির্মান করে সেখানে নামাজ পড়তে পারার ব্যবস্থা করা। যখনই নামাজের আহ্বান হবে তখন সকল কাজ বাদ দিয়ে নামাজে অংশগ্রহন করার ব্যবস্থা করা। ইসলামিক সমাজে সকল মুসলিমের জন্য নামাজের জামায়াতে শরিক হওয়া বাধ্যতামূলক করা। এই প্রসঙ্গে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, হে ব্যক্তিগণ, যারা ঈমান এনেছ, জুমআর দিন যখন নামাজের জন্যে (আজানের মাধ্যমে) ডাকা হয়, তখন বেচা-কেনা রেখে আল্লাহর স্মরণের দিকে (নামাজের দিকে) দ্রুত চলে যাও। এটি তোমাদের জন্যে উত্তম যদি জানতে।
(জুমআ : ৯)
সূরা বাকারার ৪৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। 
এই ধরনের অনুষ্ঠান নিয়মিত পালন এবং এর ব্যবস্থা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রপ্রধানেরও। সূরা হজ্জের ৪১ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘তারাই ঐসব লোক, যাদেরকে যদি আমি দুনিয়াতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করি, তারা নামায কায়েম করে, যাকাত চালু করে, ভালো কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করে। আর সকল বিষয়ের শেষ ফল আল্লাহরই হাতে”। ইসলামী সরকার কর্তৃক যে কাজগুলো করা জরুরী-

ক. সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত জামাআতে নামাযের ব্যবস্থা করতে হবে। সকল মুসলমান কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে জামাআতে শরীক হওয়ার ব্যবস্থা করা। 

খ. সরকারি হুকুমের ফলে দেশে সকল প্রতিষ্ঠানে জামাআতে নামাযের সুব্যবস্থা থাকবে।

গ. জামাআতে নামায আদায় করার জন্য সব স্থানে মসজিদ তৈরী হবে।

ঘ. ছোট বয়স থেকে সকল মুসলিম ছেলেমেয়েকে শুদ্ধভাবে নামায শেখানোর সুব্যবস্থা করতে হবে।

ঙ. নামায যে শুধু একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয় এবং নামাযের উদ্দেশ্য যে উন্নত চরিত্র গঠন করা, সে বিষয়ে সবাই সচেতন হবে।

চ. এমন পরিবেশ গড়ে তোলা, যাতে সবাই নিয়মিত জামাআতে হাজির হওয়ার জন্য তৎপর হবে।

এই জামায়াতে নামাজের অনুষ্ঠানটি কতটা জরুরী এই প্রসঙ্গে আল্লাহর রাসূল সঃ এর হাদীস থেকে পাই, আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, আল্লাহর কসম, আমার ঐ সব মুসলমানের ঘরে আগুন ধরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে যারা (বিশেষ ওজর ছাড়া) আযানের পর জামায়াতে নামাজ পড়তে না এসে, ঘরে একা নামাজ পড়ে।

উপরে বর্ণিত কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য থেকে অতি সহজে বুঝা যায় যে, ইসলাম জামায়াতে নামাজ পড়াকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি কাজ বন্ধ রেখে জামায়াতে নামাজ পড়তে আসা অনেক উত্তম। 

খ- জামায়াতে নামাজের সামাজিক শিক্ষা:
১. সমাজের সদস্যদের পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব, ভালবাসা ইত্যাদি সামাজিক গুণ সৃষ্টি করা
পবিত্র কুরআনের সূরা হুজুরাতের ১০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, মুমিনরা পরস্পরের ভাই। আল্লাহ এখানে বলছেন, এক ভাইয়ের অন্তরে অন্য ভাইয়ের জন্যে যেমন সহানুভূতি, সহমর্মিতা, স্নেহ-শ্রদ্ধা, ভালবাসা ইত্যাদি থাকে, একজন মুমিনের অন্তরেও ঠিক অন্য মুমিনের জন্যে অনুরূপ অনুভূতি থাকবে।
রাসূল সা. বলেছেন, মুসলমানদের সমাজ একটি দেহের মত। দেহের কোথাও কোন ব্যথা বা কষ্ট হলে সমস্ত দেহে তা অনুভূত হয়। আবার দেহের কোথাও সুখ অনুভূত হলে তাও সমস্ত শরীরে অনুভূত হয়। মুসলমানদের সমাজও হতে হবে অনুরূপ। অর্থাৎ তাদের সমাজের কোন ব্যক্তির উপর কোন দুঃখ-কষ্ট আসলে সমাজের সকলের উপরও তার ছাপ পড়তে হবে এবং সবাইকে সেটি দূর করারও চেষ্টা করতে হবে। আবার সমাজের কারো কোন সুখের কারণ ঘটলেও সমাজের সকলের উপর তার ছাপ পড়তে হবে।

‘মুমিনরা পরস্পরের ভাই’ কথাটি বলেই আল্লাহ ছেড়ে দেন নাই। ভাইয়ের অন্তরে ভাইয়ের জন্যে যেমন স্নেহ-শ্রদ্ধা, মমতা, ভালবাসা, সহমর্মিতা ইত্যাদি থাকে তেমন মুসলমানদের সমাজের সদস্যদের পরস্পরের অন্তরেও অনুরূপ গুণাবলী সৃষ্টি করার জন্যে, তিনি ব্যবস্থা দিয়েছেন জামায়াতে নামাজের। আর এটি জামায়াতে নামাজ পড়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

এ কথা সবাই স্বীকার করবেন যে, পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ, ওঠা-বসা যত বেশি হয়, ততই একজনের প্রতি আর একজনের মায়া-মহব্বত, স্নেহ-মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা ইত্যাদি বেশি হয়। আর তা না হলে ঐ সবগুলো বিষয়ই ধীরে ধীরে কমে যায়। জামায়াতে নামাজ মুসলমানদের সমাজের একজনের সঙ্গে আর একজনের সেই দেখা-সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। 

২. শৃঙ্খলার শিক্ষা
সামাজিক শৃঙ্খলা ব্যতীত কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। জামায়াতে নামাজের মাধ্যমে মুসলমানদের সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার অপূর্ব শিক্ষা দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মুসলমানও যদি জামায়াতে দাঁড়ায়, তবুও দেখবেন, সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে, কী সুন্দর শৃঙ্খলার সঙ্গে তারা একটি কাজ করছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ মুসলমানদের শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন, তারা যেন ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি কাজ সুশৃঙ্খলভাবে করে। এত সুন্দর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও বর্তমান বিশ্বে মুসলমানদের সামাজিক শৃঙ্খলার অবস্থা দেখলে সত্যিই দুঃখ হয়।
৩. সাম্যের শিক্ষা
পবিত্র কুরআনের সূরা হুজরাতের ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ বলছেন, হে মানুষ, আমি তোমাদের একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। এরপর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট সেই সব থেকে বেশি সম্ভ্রান্ত, যার অন্তরে আল্লাহভীতি সব থেকে বেশি।

আল্লাহ এখানে বলছেন, তিনি মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একজন পুরুষ ও একজন মহিলা থেকে। এরপর তিনি তাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছেন। তবে এই বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য পরস্পর সম্মান ও মর্যাদা নির্ণয় করা নয় বরং পরস্পরকে সহজে চেনার ব্যবস্থা করা। এরপর আল্লাহ বলেছেন, তাঁর নিকট মানুষের সম্মান-মর্যাদার মাপকাঠি হচ্ছে আল্লাহভীতি। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় যার অন্তরে যত বেশি, আল্লাহর নিকট সে তত বেশি মর্যাদাশীল। আল্লাহর ভয়ই মানুষকে অন্যায় কাজ থেকে দূরে রাখে এবং ন্যায় কাজ করতে বাধ্য করে। তাহলে আল্লাহ বলছেন, ন্যায় কাজ করা বা বাস্তবায়ন করা এবং অন্যায় থেকে দূরে থাকা বা তা প্রতিরোধ করাই হচ্ছে মানুষের মর্যাদাশীল হওয়ার মাপকাঠি। বংশ, জাতি, ধনী-গরীব, কালো-সাদা, মনিব-চাকর ইত্যাদি নিয়ে যেন অহংকার সৃষ্টি না হতে পারে, সে জন্যে তিনি কর্মপদ্ধতিও তৈরি করে দিয়েছেন। সেই কর্মপদ্ধতি হচ্ছে ‘জামায়াতে নামাজ’। একজন মুসলমান দিনে পাঁচবার জামায়াতে নামাজের সময় তার বংশ, ভাষা, গায়ের রং, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি পরিচয় ভুলে গিয়ে অন্য মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে এক লাইনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় মনিবের পাশেই তাঁর ভৃত্য দাঁড়াতে পারে বা মনিবের মাথা যেয়ে লাগতে পারে সামনের কাতারে দাঁড়ানো তাঁর ভৃত্যের পায়ের গোড়ালিতে। এভাবে দিনে পাঁচবার বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মুসলমানদের অন্তর থেকে বংশ, বর্ণ, ভাষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিচয়ভিত্তিক অহংকার সমূলে দূর করার অপূর্ব ব্যবস্থা করা হয়েছে।

৪. সমাজ পরিচালনা পদ্ধতির বাস্তব শিক্ষা
মানবসমাজের সুখ, শান্তি, উন্নতি, প্রগতি ইত্যাদি নির্ভর করে সুষ্ঠুভাবে সমাজ পরিচালনার ওপর। সুষ্ঠুভাবে সমাজ পরিচালনা করতে হলে কী কী বিষয় দরকার, জামায়াতে নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহ প্রতিদিন পাঁচ বার তা মুসলমানদের মনে করিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। সেই বিষয়গুলো হচ্ছে-

ক. নেতা নির্বাচন করা
জামায়াতে নামাজের সময়, একের অধিক লোক হলেই একজন ইমাম বা নেতা বানাতে হয়। এখান থেকে আল্লাহ শিক্ষা দিচ্ছেন, কোন সামাজিক কর্মকাণ্ড, যেখানে একের অধিক লোক জড়িত, তা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হলে একজন নেতা অবশ্যই নির্বাচন করতে হবে।

খ. পুরুষ না মহিলা নেতা
জামায়াত যদি শুধু পুরুষের হয় বা পুরুষ ও মহিলা মিশ্রিত হয়, তাহলে পুরুষ ইমাম হবে। কিন্তু জামায়াত যদি শুধু মহিলাদের হয়, তবে সেখানে মহিলা ইমাম হতে পারবে। এ থেকে আল্লাহ শিক্ষা দিতে চাচ্ছেন, যে সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড পুরুষ ও মহিলা অধ্যুষিত বা শুধু পুরুষ অধ্যুষিত, সেখানে পুরুষই নেতা হবে। আর যে সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড শুধু মহিলা অধ্যুষিত, সেখানে মহিলা নেতা হতে পারবে।

এর কারণ হল, পুরুষ ও মহিলা মিশ্রিত সামাজিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে চালাতে হলে, একটি বিশেষ দৈহিক, বুদ্ধি-বৃত্তিক ও মানসিক গঠন দরকার। যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তিনিই সব থেকে ভাল জানেন, ঐ ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যে ঐ তিনটি গুণের প্রয়োজনীয় সমন্বয় কার মধ্যে অপেক্ষাকৃত ভাল আছে। এ বিষয়টি বিবেচনা করে তিনি পুরুষকেই সে দায়িত্ব দিয়েছেন। আর এটি অত্যন্ত সুন্দরভাবে আল্লাহ বলেছেন, সূরা নিসার ৩৪ নং আয়াতে। পুরুষেরা হচ্ছে নারীর পরিচালক। কারণ, আল্লাহ তাদের একজনকে অপরের উপর বিশিষ্টতা দান করেছেন।

গ. নেতা হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ
যে গুণাবলী থাকলে কোন ব্যক্তি নেতা হতে পারবে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুণগুলো রাসূল সা. সুন্দরভাবে মুসলমানদের জানিয়ে দিয়েছেন, নামাজের ইমাম হওয়ার গুণাবলী বর্ণনাকারী নিম্নের হাদীসগুলোর মাধ্যমে-
হযরত আবু মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : মানুষের ইমামতি করবে সে-ই, যে কুরআন ভাল পড়ে। যদি কুরআন পড়ায় সকলে সমান হয়, তবে যে সুন্নাহ বেশি জানে। যদি সুন্নাহেও সকলে সমান হয়, তবে যে হিজরত করেছে সে। যদি হিজরতেও সকলে সমান হয়, তবে যে বয়সে বেশি। কেউ যেন অপর ব্যক্তির অধিকার ও সেইস্থলে ইমামতি না করে এবং তার বাড়িতে তার সম্মানের স্থলে অনুমতি ব্যতীত না বসে। (মুসলিম)

এ হাদীসটিতে রাসূল সা. ইমাম হওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় গুণাগুণ বা যোগ্যতাগুলো যে ক্রম অনুযায়ী উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে-
ক. শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা,
খ. সুন্নাহ তথা হাদীসের জ্ঞান থাকা,
গ. হিজরত করা এবং
ঘ. বেশি বয়স।
হযরত আবু সায়ীদ খুদরী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন : যখন তিন ব্যক্তি হবে, তখন যেন তাদের মধ্য হতে একজন ইমামতি করে এবং ইমামতির অধিকার তার, যে কুরআন অধিক ভাল পড়ে। (মুসলিম)

আমর ইবনে সালেমা রা. বলেন, আমরা লোক চলাচলের পথে একটি কূপের নিকট বাস করতাম, যেখান দিয়ে আরোহীগণ চলাচল করত। আমরা তাদের জিজ্ঞাসা করতাম, মানুষের কী হল? তারা যে লোকটি সম্বন্ধে বলে তিনি কে? তারা উত্তর করত, লোকটি মনে করে তাকে আল্লাহ রাসূল করে পাঠিয়েছেন এবং তার প্রতি এইরূপ ওহী নাযিল করেছেন। তখন আমি ওহীর বাণীটি এমনভাবে মুখস্থ করে নিতাম যে তা আমার অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যেত। আরবগণ যখন ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে মক্কা বিজয়ের অপেক্ষা করছিল, তখন তারা বলত তাকে (মুহাম্মাদকে) তার গোত্রের সাথে বুঝতে দাও। যদি সে তাদের উপর জয়লাভ করে তখন বুঝা যাবে, সে সত্য নবী। যখন মক্কা বিজয়ের ঘটনা ঘটল, তখন সকল গোত্রই ইসলাম গ্রহণে তাড়াহুড়ো করল এবং আমার পিতা গোত্রের অন্য সকলের আগে ইসলাম গ্রহণ করলেন। তিনি গোত্রে ফিরে এসে বললেন, আল্লাহর কসম আমি তোমাদের নিকট এক সত্য নবীর নিকট থেকে ফিরে এসেছি। তিনি বলে থাকেন, এই নামাজ এই সময় পড়বে এবং ঐ নামাজ ঐ সময় পড়বে। যখন নামাজের সময় উপস্থিত হবে, তখন তোমাদের মধ্য হতে কেউ যেন আযান দেয় এবং তোমাদের মধ্যে ইমামতি যেন সেই ব্যক্তি করে যে অধিক কুরআন জানে। তখন লোকেরা দেখল, আমার অপেক্ষা অধিক কুরআন জানে এমন কেউ নেই। কেননা আমি পথিকদের নিকট হতে পূর্বেই তা মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। তখন তারা আমাকেই তাদের আগে বাড়িয়ে দিল অথচ তখন আমি ছয় কি সাত বছরের বালকমাত্র।  (বুখারী)

এ হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, নামাজের ইমাম হওয়ার জন্যে কুরআনের জ্ঞান থাকা বয়সের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. এর হিজরতের পূর্বে যখন প্রথম মুহাজির দল মদীনা পৌঁছলেন, তখন আবু হুযায়ফার গোলাম সালেম রা. তাদের ইমামতি করতেন। অথচ তাদের মধ্যে তখন ওমর এবং আবু সালামা ইবনে আবদুল আসাদের ন্যায় লোকও বিদ্যমান ছিলেন। (বুখারী)

হযরত সালেহ একদিকে যেমন কুরআনের বড় জ্ঞানী ছিলেন, অপরদিকে তিনি বড় কারীও ছিলেন। রাসূল সা. যে চার ব্যক্তির নিকট থেকে কুরআন শিখতে বলেছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। এ হাদীসটি থেকে বুঝা যায়, ইমাম হওয়ার যোগ্যতার মধ্যে শুদ্ধ করে পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকার গুরুত্ব বংশ, গোত্র, দেশ অথবা মনিব, গোলাম ইত্যাদির চেয়ে ওপরে।
উল্লিখিত হাদীসগুলো থেকে নিশ্চয়তা দিয়েই বলা যায়, নামাজের ইমাম হওয়ার যোগ্যতা বা গুণাগুণগুলোর প্রথম চারটিকে গুরুত্বের ক্রম অনুযায়ী রাসূল সা. যেভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন বা উল্লেখ করেছেন, তা হচ্ছে-
১. শুদ্ধ করে কুরআন পড়াসহ কুরআনের জ্ঞান থাকা,
২. হাদীসের জ্ঞান থাকা,
৩. হিজরত করা এবং
৪. বয়স। 

কুরআনের জ্ঞান ও হাদীসের জ্ঞান থাকা খুব সহজে বুঝা গেলেও হিজরত আমাদের সাধারণত বুঝাটা একটু কষ্টকর। মদীনার প্রাথমিক সময়ে হিজরত ছিল সবচেয়ে বড় আমল যা করতে সবচেয়ে বেশী ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। হিজরত করেছেন তারা যারা দ্বীন কায়েমের জন্য তাদের সকল সহায় সম্পত্তি আত্মীয় স্বজন বিসর্জন দিয়েছেন। এখনো আমাদের দেশে যারা দ্বীন কায়েমের পথে নিয়োজিত আছেন। শ্রম দিচ্ছেন ত্যাগ স্বীকার করছেন তারা নেতা হওয়ার জন্য অধিকতর যোগ্য। 

ঘ. নেতা নির্বাচন পদ্ধতির শিক্ষা
মুসলিম সমাজ বা দেশের নেতা তথা কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকার পরিষদের নেতা কী পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচন করতে হবে সেটি মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন নামাজের ইমাম নির্বাচনের পদ্ধতির মাধ্যমে, যা প্রত্যেক নামাজীকে প্রতিদিন পাঁচবার অনুশীলন করতে হয়। নামাজের ইমাম নির্বাচনের ঐ পদ্ধতি রাসূল সা. জানিয়ে দিয়েছেন নিম্নের হাদীসগুলোর মাধ্যমে,
ইবনে উমর রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ কবুল হবে না।  যে কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয়েছে অথচ তারা তাকে পছন্দ করে না, যে নামাজ পড়তে আসে দিবারে। আর দিবার হল- নামাজের উত্তম সময়ের পরের সময়কে এবং যে কোন স্বাধীন নারীকে দাসীতে পরিণত করে। (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।

আবু উমামা রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের কানের সীমা অতিক্রম করে না (অর্থাৎ কবুল হয় না) পলাতক দাস যতক্ষণ না সে ফিরে আসে, যে নারী রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী তার ওপর অসন্তুষ্ট এবং গোত্র বা জাতির ইমাম কিন্তু মানুষ তাকে পছন্দ করে না। (তিরমিযী, তবে হাদীসটিকে ইমাম তিরমিযী গরীব বলেছেন)

ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূল সা. বলেছেন, তিন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপর এক বিঘতও ওঠে না অর্থাৎ কখনই কবুল হয় না। ক. যে ব্যক্তি কোন গোত্র বা জাতির ইমাম হয় কিন্তু তারা তাকে পছন্দ করে না, খ. সেই নারী যে রাত্রি যাপন করেছে অথচ তার স্বামী সঙ্গত কারণে তার ওপর নাখোশ এবং গ. সেই দুই ভাই যারা পরস্পরে বিচ্ছিন্ন। (ইবনে মাজাহ)

উপরিউক্ত হাদীসগুলো থেকে একথা স্পষ্ট কোন ব্যক্তির ইমামতির যোগ্যতা থাকার পরও মুক্তাদী বা অনুসারী বা জনগনের ভোট বা সমর্থন জরুরী। অধিকাংশ জনগনের সমর্থন না থাকলে তিনি ইমামতি তথা নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারান। 

এই সকল হাদীসের আলোকে স্পষ্টভাবে নামাজের ইমাম নির্বাচনের ব্যাপারে যে বিধি-বিধান বের হয়ে আসে এবং যা প্রতিটি মুসলমান বাস্তব আমলের ভিত্তিতে দিনে পাঁচবার অনুসরণ করছে, তা হচ্ছে-

ক. ভোট বা সমর্থনের মাধ্যমে সকল বা অধিকাংশ মুক্তাদি যাকে পূর্বোল্লিখিত গুণাগুণসমূহের ভিত্তিতে অধিকতর যোগ্য মনে করবেন তিনি নামাজের ইমাম হবেন। আর এই সমর্থন দিতে হবে সকল রকম অন্যায় প্রভাব মুক্ত হয়ে।

খ. ঐ পদ্ধতি অনুসরণ করে ইমাম নির্বাচন করা ইসলামের একটি মৌলিক বিধান। কারণ, রাসূল সা. বলেছেন, ঐ পদ্ধতি অনুসরণ না করে যে ইমাম হবে, তার নামাজ কবুল হবে না। সুতরাং তাকে জাহান্নামে যেতে হবে অর্থাৎ তার সকল কর্মকাণ্ড ব্যর্থ হবে।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, নামাজের অনুষ্ঠান থেকে আল্লাহ মুসলমানদের বিভিন্ন শিক্ষা দিতে চেয়েছেন। আর নামাজের ইমাম নির্বাচনের বিধি-বিধানের মাধ্যমে মহান আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন, সমাজের নেতা নির্বাচন করার বিধি-বিধান। তাহলে সমাজের নেতা নির্বাচনের সেই বিধি-বিধানগুলো হবে

১. নেতা নির্বাচিত করতে হবে সকল বা অধিকাংশ ঈমানদার মুসলমানের সমর্থন তথা ভোটের মাধ্যমে।
২. সকল বা অধিকাংশ ঈমানদার মুসলমান ঐ ভোটের মাধ্যমে জানাবেন কোন ব্যক্তি তাদের মতে নেতা হওয়ার জন্যে পূর্বোল্লিখিত গুণাগুণের ভিত্তিতে অধিকতর যোগ্য।
৩. ঐ ভোটগ্রহন হতে হবে সকল প্রকার অন্যায় প্রভাবমুক্তভাবে।

আমরা যাতে নামাজকে ব্যক্তিগতভাবে এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি সেজন্য জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শুধু নিয়মিত নামাজ আদায় নয় এর শিক্ষাও বাস্তবায়ন করতে হবে নতুবা আমাদের নামাজ কায়েমের হক আদায় হবে না। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবো। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদের প্রকৃতভাবে নামাজ কায়েমের তাওফীক দান করুন। 

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০১৬

জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ এবং আমেরিকায় সমকামী হত্যা


জামায়াত একটা মুনাফিক টাইপ দল। কারণ জামায়াত একবার জোট বাঁধে আওয়ামীলীগের সাথে আন্দোলন করে বিএনপির বিরুদ্ধে। আবার কিছুদিন পর বিএনপির সাথে ঘর সংসার করে আন্দোলন করে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে। এদের চরিত্রের ঠিক নাই। এরা নিজেদের মত করে ইসলামকে ব্যবহার করে। এরা ধর্মব্যবসায়ী। এই ধরণের অভিযোগ আপনি করতেই পারেন। কারণ আপনার ইনফো সঠিক, তবে সকল ইনফো আপনার জানা নেই অথবা আপনি জানা থাকলেও গোপন করেছেন। তাই ইনফরমেশনের যে ব্যাখ্যা আপনি করেছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। 

১৯৮৪ সালে জামায়াত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলার প্রস্তাব দেয় রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে। কারন সে সময়ের ধূর্ত শাসক লে জে হু মু এরশাদের অধীনে নির্বাচন কারো পক্ষে মানা সম্ভব ছিল না। জামায়াতের এই ফর্মুলা সেসময় সরকারি দলতো গ্রহন করেইনি। বিরোধী দলের মধ্যেও কেউ গ্রহন করেনি। একই ফর্মূলা সকল বিরোধী দল গ্রহন করেছে ১৯৮৯ সালে। সকল বিরোধী দল তখন এই ফর্মূলা বাস্তবায়নের জন্য যুগপৎ আন্দোলন শুরু করে। তারই প্রেক্ষিতে গণঅভ্যুত্থান হয় এরশাদের পতন হয়। 

১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলাতে নির্বাচন হয়। বিএনপি অল্পের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা মিস করে। জামায়াত ১৮টি সিট পায়। জামায়াত বিএনপিকে সমর্থন দেয়, বিএনপির সরকার গঠন করে। এর কিছুদিন পরই সংসদে দাবী উঠে এই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার। আওয়ামীলীগ এই দাবী উত্থাপন করে। বিএনপি এই দাবী প্রত্যাখ্যান করে। এই নিয়ে জামায়াত বিএনপিকে রাজী করানোর চেষ্টা করে। সেই সময় সংসদে মাওলানা নিজামী খালেদাকে বলেন আমরা মোটেই আপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে ইচ্ছুক নয়। আমরা দেশগঠনে আপনাকে সহায়তা করতে রাজী। কিন্তু আপনি জোর করে আমাদের আপনার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে বাধ্য করবেন না। কিন্তু সেই সময়ের অহংকারী খালেদা জিয়া সেটা মেনে নিতে অসম্মত হয়। জামায়াত তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আওয়ামীলীগের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু যতটা না আওয়ামীলীগের তার চাইতে বেশী জামায়াতের। 

তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা মানতে বাধ্য হয় বিএনপি। ১৯৯৬ তে দু'বার নির্বাচন হয়। ১ম বার সকল বিরোধী দল বয়কট করে। পরবর্তিতে তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচন হয়। আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামীলীগ তার পূর্বের আচরণ মতই ধর্মনিরপেক্ষ হতে গিয়ে ইসলাম বিরোধী হয়ে উঠে। ভারতকে খুশি রাখার জন্য একের একের পর এক কালো অসম চুক্তি করতে থাকে। কয়েকটি মাদ্রাসা বন্ধ করে দেয়। দাড়িটুপি নির্যাতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হকের মত মানুষও তাদের হাতে লাঞ্চিত হয়। 

এই পরিস্থিতিতে জামায়াত আওয়ামীলিগের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এর মধ্যে পার্বত্য শান্তিচুক্তির মত দেশকে ভাগ করে দেয়ার চুক্তি করে সরকার। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে বিএনপি ও জামায়াত। এই আন্দোলনই দুই শক্তিকে আবার একই মঞ্চে আনে। সেখানে এরশাদও ছিল। পরবর্তিতে চার দলীয় জোট গঠন হয়। প্রথমে এরশাদ জোটে ছিল, পরবর্তিতে সে বের হয়ে যায়। জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমদের ভারতপন্থীদের অত্যাচার হতে রক্ষা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। সেই জোট এখনো বিদ্যমান। এখনো এই জোটের মূল দাবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ঘটনা কি দাঁড়ালো? জামায়াত তার প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবীতে সবসময় অটল ছিল। কোন কোন রাজনৈতিক দল তাদের ইচ্ছেমত জামায়াতের সাথে আন্দোলন করেছে বা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। এবার পরিস্থিতি বিবেচনায় আপনি নিশ্চয়ই জামায়াতকে এই ইস্যুতে মুনাফিক বলতে চাইলেও বলতে পারবেন না।

এবার আসুন সমকামী ইস্যুতে। জামায়াত আমেরিকায় সমকামী হত্যায় নিন্দা জানিয়েছে। এতে উৎপুল্ল হয়ে আপনি জামায়াতকে সমকামী আখ্যা দিতে আপনার বাধে না। আপনি জামায়াতকে গে জামায়াত বলে উল্লাস করছেন আর বলছেন দেখ দেখ আগেই বলেছিলাম জামায়াত ইহুদী-নাসারা কওমে লুতের অনুসারী। এখন তো প্রমাণ হলো। 

এখানেও আপনার সমস্যা ওটাই। আপনার যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে জামায়াতকে দোষারোপ করছেন সেটা সত্য। তবে হয় সব তথ্য আপনার কাছে নেই অথবা আপনি কিছু তথ্য গোপন করেছেন। 

আমেরিকায় এই ধরণের সাইকো হামলা নতুন নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে। তবে সেক্ষেত্রে জামায়াতের বিবৃতি প্রদানের প্রয়োজন পড়ে নি। কারণ আগের প্রত্যেকটি ঘটনায় খুনী ছিল অমুসলিম। আর বিষয়টা নিয়ে রাজনীতিও হয়নি। সবাই ঐসব খুনীকে অপ্রকৃতস্থ বলেছে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে আলোচনা হয়েছে তা হয়েছে অস্ত্র আইন সংশোধন করা দরকার। যারা প্রায়ই মাতাল হয় তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের দাবী উঠেছিল। কোন পক্ষ থেকেই দাবী জানানো হয় নি এটি একটি সাম্প্রদায়িক হত্যা। 

কিন্তু সমকামীদের হত্যাকারী হিসেবে যখনই একজন মুসলিম নাম এসেছে তখনই সারা বিশ্বে হইচই শুরু হয়েছে। তখন আর কেউ উমর মতিন নামে লোকটিকে কেউ মাতাল বলতে রাজী না, সমকামী বলতে রাজী না এখন তার পরিচয় সে একজন মুসলিম। ব্যাস সকল সন্ত্রাসী ঘটনার দায় নিতে হচ্ছে ইসলামকে। পুরো বিশ্বের মিডিয়া ইসলামকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। আর এই ঘটনায় তাল দেয়ার জন্য আছে CIA এবং মোসাদের যৌথ প্রযোজনার আই এস। কোন কিছু বিবেচনা করার আগেই তারা এই ঘটনার দায় স্বীকার করে। শুধু এই ঘটনা নয় সারা পৃথিবীর আনাচে কানাচে যে কোন যায়গায় কোন মুসলিম নামধারী কোন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড করলেই তারা সেই ঘটনার দায় স্বীকার করে ইসলামকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করে। এটা তাদের এজেন্ডা। 

এই ধরণের প্রতিটি ঘটনায় বিপদে পড়েন মুসলিমরা। তারা অমুসলিম দেশে তাদের স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। অযথা হয়রানির শিকার হন। সবচেয়ে বড় কথা হলো ক্ষতিগ্রস্থ হয় ইসলাম। ইসলাম তখন বিবেচিত হয় সন্ত্রাসীদের ধর্ম হিসেবে। অনেক নালায়েক আছেন যারা ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে কুরআন হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে এসব সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে জায়েজ করার চেষ্টা করেন। 

জামায়াত সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে। সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তারা নিয়োজিত। সাধারণত তারা যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার সেটা যদি তাদের শত্রুর সাথেও হয়ে থাকে। আর সেই অন্যায় যদি ইসলামের বিরুদ্ধে হয়ে থাকে তবে সেখানে জামায়াত সবসময় সোচ্চার। এটা জামায়াত ঈমানের দাবী মনে করে। জামায়াতের বিবৃতি যতটা না ছিল নিহতদের প্রতি সংহতি বরং তার চাইতেও বেশী হচ্ছে ইসলামকে সমুন্নত করা। ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা। জামায়াত তার বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে এমন কোন হত্যাকান্ডকে ইসলাম সমর্থন করে না, করতে পারে না। এই হত্যাকান্ডের সাথে ইসলামপন্থীদের সংযোগ নেই। 

অবশ্যই ইসলামে সমকাম একটি ফৌজদারি অপরাধ। তবে এটা অবশ্যই ইসলামিক রাষ্ট্রে, যেখানের অধিকাংশ মানুষ সতঃস্ফুর্তভাবে ইসলামকে গ্রহন করবে। ইসলামিক কানুন মেনে চলবে। তবে ইসলাম কখনোই কোন ব্যক্তিকে কোন শাস্তি বিধানের অনুমতি দেয় না। বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড মেনে নেয় না। কুরআনে মুশরিকদের হত্যা করার জন্যও বলা হয়েছে তাই বলে কি আপনার অনুমতি আছে পাশের বাড়িতে শিরক করা কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বি মানুষকে হত্যা করা? অথচ শিরক করা আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে বড় অপরাধ। হাদীসে সমকামীদের হত্যা করার জন্য বলা হয়েছে এর মানে এই নয় যে আপনি কোন সমকামীকে হত্যা করতে পারবেন বরং এই হাদীসের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হলো সমকাম ঘৃণিত জিনিস, প্রকৃতি বিরুদ্ধ এবং ফৌজদারী অপরাধ। রাষ্ট্র শাস্তির ব্যবস্থা করবে, সাধারণ নাগরিকদের সেই অধিকার ইসলাম দেয়নি। 

এজন্য কুরআন, হাদীস যাই ব্যখ্যা করবেন সাবধানে করবেন। কোন সময় কি পরিস্থিতিতে আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালা এবং মুহাম্মদ সঃ এই কথাগুলো বলেছেন সেটা বিবেচনা করবেন। আর জামায়াতের ব্যাপারে নতুন করে কিছু বললাম না। জামায়াত সবসময় প্রস্তুত আপনাদের সমালোচনা গ্রহন করার জন্য। এটলিস্ট জামায়াত এই কাজটা ভালো পারে :)

মঙ্গলবার, ৩১ মে, ২০১৬

অপদার্থ প্রজন্ম, ফেরাউন এবং আমাদের করণীয়


ভবিষ্যত প্রজন্মকে মূর্খ ও অপদার্থ হিসেবে তৈরী করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করা নতুন কোন পদ্ধতি নয়। ফেরাউনও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। এদেশে ইংরেজরাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বামপন্থি নাহিদও সে পথই অনুসরণ করেছে। আপনারা একটা ভাইরাল হওয়া ভিডিও দেখেছেন যেখানে ছাত্ররা খুব কমন কিছু প্রশ্নের উত্তর জানেনা। অথচ তারা সর্বোচ্চ স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। এটা দুঃখজনক। শিক্ষার মান ক্রমেই কমছে। এটা বড় একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। 

অনেক আগে ফেরাউন যখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, তখন সে তার মন্ত্রী হামানকে তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছিল। হামান তাকে ধৈর্য্য ধরতে বলেছিল এবং পরামর্শ দিয়ে বলেছিল আপনি এখনি যদি নিজেকে সর্বশক্তিমান দাবী করেন তাহলে জনগণ তা মেনে নিবে না। কারণ তারা অনেক কিছু জানে। আপনি প্রথমে সকল বিদ্যালয় বন্ধ করে দিন। তাহলে এখনকার কিশোরেরা সব মূর্খ হয়ে বড় হবে। কিছু বছর পর তারা যুবক হবে। তখন তারা আপনি যা বলবেন তাই শুনবে।

ফেরাউন তাই করলো। মন্ত্রী হামানের পরামর্শ মতো ফেরাউন সমগ্র রাজ্যের মাতব্বর প্রজাদের ডেকে একটা বড় সভা করলেন। সেই সভাতে তিনি তাদের বুঝিয়ে দিলেন যে, লেখাপড়া শিখে মিছামিছি সময় নষ্ট করবার আর প্রয়োজন নেই। কারণ, লোকের পরমায়ু অতি অল্পকাল। এই সংকীর্ণ সময়ের মধ্যে জীবনের বেশির ভাগ দিনই যদি মক্তবে এবং পাঠশালায় গমনাগমন করে এবং পড়ার ভাবনা ভেবে ভেবে কাটিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আমোদ আহলাদ এবং স্ফুর্তি করবার অবসর পাওয়া যাবে না। সুতরাং সারাজীবন ভরে আমোদ করো, মজা করো। তাহলে মরবার সময়ে মনে বিন্দুমাত্র অনুতাপ আসবে না।

প্রজারা ফেরাউনের ও হামানের এই উপদেশ সানন্দে গ্রহণ করলো এবং বংশধরদের কাউকে আর বিদ্যালয়ে প্রেরণ করবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিলো।অতঃপর হামান পাঠশালা ও মক্তব রাজ্য থেকে উঠিয়ে ঢাক পিটিয়ে দেশময় প্রচার করে দিলো যে, কেউ আর লেখাপড়া শিখতে পারবে না। রাজার আদেশ অমান্য করলে সবংশে তার গর্দান যাবে।

প্রজারা ফেরাউনের আদেশ মতো চলতে লাগলো। লেখাপড়া আর কেউ শিখতে চেষ্টা করলো না। সারাদেশে কিছুকালের মধ্যে একেবারে গণ্ডমুর্খতে পূর্ণ হয়ে গেল। মূর্খের অশেষ দোষ। কোন ধর্মাধর্ম, হিতাহিত জ্ঞান তার থাকে না। তারা হয় কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। দুনিয়ার এমন কোন অসৎ কাজ নেই যা মূর্খরা না করতে পারে! যখন তার রাজ্যের প্রজাদের এই অবস্থা ফেরাউন মনে মনে হাসতে লাগলো। তার উদ্দেশ্য এতদিনে সিদ্ধ হয়েছে। তিনি প্রত্যেককে একটা করে নিজের প্রতিমূর্তি দিয়ে তাকে সৃষ্টিকর্তা এবং উপাস্য বলে পূজা করতে হুকুম দিলেন। মূর্খ ও অপদার্থ প্রজন্ম ফেরাউনের আনুগত্য করতে লাগলো।

বাম আদর্শে বড় হওয়া নাহিদরা ভালো করেই জানে এদেশবাসী যখন ভালো শিক্ষিত হয়ে গড়ে উঠবে তখন তাদের বস্তাপঁচা আদর্শ তারা গ্রহন করার প্রশ্নই আসে না। বরং তাই হচ্ছে। এদেশে যখন বাম আদর্শ বিস্তার শুরু করছিলো তখন তাদের চটকদার কথা শুনে অনেক জ্ঞানী মানুষ তাদের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করেছিলো। কিন্তু কালক্রমে তাদের আদর্শের অসারতা বড় হয়ে ধরা পড়ে সকলের সামনে। বড় দলগুলো ক্রমেই ছোট হয়ে আসতে শুরু করে।

নতুন করে তারা আবার দলভারী করতে চায়। বস্তাপঁচা আদর্শ গিলাতে চায় এই জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মের মগজে। তাই তাদের দরকার একটা অপদার্থ প্রজন্ম। সেটাই নাহদ তৈরী করতে সক্ষম হচ্ছে। এজন্য তারা পলিসি গ্রহন করেছে প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন না দেয়া। ভালো ও খারাপের ক্যাটাগরি সমান করে দিয়েছে। ছেলেরা আরো ভালো কিছু করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ আরো এমনসব পলিসি গ্রহন করেছে যাতে একটা নির্বোধ জাতির সৃষ্টি হয়। 

এর বিপরীতে আমাদের করণীয় কি হওয়া উচিত এই বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। ইসলামের প্রথম নির্দেশ পড়। ইসলামিক সমাজে একজন মূর্খ ব্যক্তি অবশ্যই অপরাধী। মূর্খ ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পারে না এমনকি স্রষ্টাকেও চিনতে পারেনা। তাই জ্ঞানঅর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। নিজের শিশুসন্তানকে সুশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে আদর্শ মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পরিবারের ভূমিকা অপরিসীম। 

পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানের সাথে জীবনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। বিশেষ করে জীবনের দর্শন কী তা সন্তানকে বুঝিয়ে থাকেন। জীবন কেন? জীবনের উদ্দেশ্য কি? দুনিয়ার জীবনে আমাদের করণীয় কি? আমাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত এসব বিষয়ে যথাযথ শিক্ষা দিবেন। এক্ষেত্রে সাধারণ বাঙ্গালী সমাজে যা শিক্ষা দেয়া হয় তা হলো এই সমাজে পয়সা উপার্জন করে সুখে শান্তিতে থাকাই জীবনের সঠিক পথ। কিন্তু পিতা মাতাদের উচিত এই ধারণা থেকে বের হয়ে আল্লাহর দেয়া বিধি-নিষেধ এবং আল্লাহ কর্তৃক পরীক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া।   

পরিবার যথাযথ ভূমিকার মাধ্যমে সন্তানকে একজন সামাজিক ব্যক্তিত্বরূপে গড়ে উঠতে এবং বিভিন্ন নৈতিক গুণ অর্জন করতে সহায়তা করবে। সন্তানকে একজন ভালো নাগরিক তৈরীর উদ্দেশ্যে পরোপকারের শিক্ষা দিতে হবে। এই সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা। প্রতিবেশীদের অধিকার, অন্যান্য মুসলিমদের অধিকার শিক্ষা দিতে হবে। ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের আলোর পথে আসার জন্য যোগ্য দায়ী হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।  

পরিবার থেকেই সন্তান সম্পদ উৎপাদন, জীবিকা বণ্টন এবং সম্পদের ব্যবহার বিষয়ে জ্ঞানলাভ করবে এবং দারিদ্র্য ও সচ্ছলতার অর্থ অনুধাবন করতে পারবে। ভাই বোন পিতা মাতাসহ সকল আত্মীয়ের প্রতি আর্থিকভাবে যত্নবান হতে শিখবে।  

শিশুরা প্রকৃতিগতভাবে অজ্ঞতা নিয়েই জন্মলাভ করে। সকল শিশুই প্রথমে দুনিয়া সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকে। মানুষের মাঝে যে সকল সমস্যা রয়েছে এবং পৃথিবীতে যে সকল কর্মকান্ড সংঘটিত হয় সে সম্পর্কে শিশুরা অনেক কিছুই জানে না। শিশু বড় হওয়ার সাথে সাথে এ সকল বিষয়ে জানতে শুরু করে। তার মাঝে জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। জীবন ও জগৎ সম্পর্ক যতই সে প্রশ্নের সম্মুখীন হয় ততই তার মাঝে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে; ভালো-মন্দ সম্পর্কে সে বিচার করতে শুরু করে। এই সময়ে শিশুর পথ প্রদর্শকের প্রয়োজন। পিতামাতাই কেবল এই পর্যায়ে শিশুকে যথোপযুক্ত জ্ঞানদানের জন্য এগিয়ে আসতে পারেন। বরং বলা উচিত এ সময়ে শিশুর জ্ঞান বিকাশে সহায়তা করা মাতাপিতার অবশ্যকর্তব্য। শিশুর প্রতিটি প্রশ্নের পেছনে একটি প্রবল শক্তি কাজ করে যা তার জ্ঞানার্জনের পথকে উন্মোচিত করে দেয়। শিশুর অন্তর্নিহিত কৌতুহলই তাকে জীবন পথে চলার প্রাণশক্তি যোগায়।

পৃথিবীর জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার জন্য শিশুর প্রয়োজন পৃথিবীকে ভালোভাবে জানা। এই পৃথিবীর সভ্যতার সত্যিকারের ইতিহাস শিশুর জানা উচিত যাতে ঘটে যাওয়া পুরনো ঘটনা থেকে সে শিক্ষা নিতে পারে। জীবন পথে চলার জন্য তার কোন দর্শন অবলম্বন করা উচিত, কোন লক্ষ্যে অগ্রসর হওয়া উচিত। এছাড়া কিভাবে তার পথ চলা উচিত তাও শিশুর জানা দরকার। এই বিষয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন পরিবারের গুরুজনেরা। 

নিজে নিজে প্রতিভার বিকাশ ঘটানো শিশুর পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীর লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকাও তার জন্য খুব কঠিন। তাই পিতা-মাতাই কেবল পারেন তার শিশুকে সঠিক পথে নিয়ে গিয়ে সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে, পিতামাতারা তার নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তম বিষয়গুলো সন্তানদের শিখিয়ে দিতে পারেন।

শিশুর জীবনের প্রথম বছরগুলোতে পিতামাতাই হবেন একজন জ্ঞানী অভিভাবক। শিশুর নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হয় এসময়। পিতাকে অকপটে এবং অবলীলাক্রমে শিশুর এ সকল কৌতুলহল মেটাতে হবে। কারণ, শিশুর ভবিষ্যৎ জীবনের অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করার দায়িত্ব তো পিতামাতার। তার ক্রমাগত প্রশ্নকে উপেক্ষা না করে বিরক্ত না হয়ে যথাযথ উত্তর করার চেষ্টা করা উচিত। মা-বাবা যদি শিশুদেরকে এসকল বিষয় জানা থেকে বঞ্চিত করেন তাহলে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়; শিশু অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। এ জন্য বাবা-মার উচিত তার সন্তানের সাথে যতটা সম্ভব আন্তরিক এবং খোলামেলা হওয়া। পিতার আচার-ব্যবহার এমন হবে যাতে শিশু বুঝতে পারে যে, পিতা-মাতাই হলো তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু। একটি পরিবারে অভিভাবকরা যতটা উপকারী ভূমিকা পালন করতে পারে অন্যরা তা পারে না। 

আমাদের অনেকেরই একটি ভুল ধারণা যে, সাংস্কৃতিক ভূমিকা শুধু স্কুলই পালন করে। আমাদের এটা জানা উচিত শিশুর জ্ঞানার্জনের ভিত্তি স্থাপিত হয় পরিবারের দ্বারা। পরিবারেই একটি শিশু প্রথম বিশ্বজগতের বিশাল পরিমন্ডলে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। পরিবারেই শিশু তার ভবিষ্যত জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পৌঁছার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা পেয়ে থাকে। 

শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য পিতামাতার পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা দরকার। সেই সাথে পিতামাতার দৃষ্টিভঙ্গিও প্রসারিত হওয়া উচিত। পিতামাতা যদি শুধু সন্তানের দৈহিক চাহিদা মেটানোর প্রতিই মশগুল থাকেন তাহলে তাঁদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ হয় না। শিশুসন্তানদের প্রতি মাতাপিতার অন্যতম দায়িত্ব হলো শিশুকে জ্ঞান শিক্ষা দেয়া। অর্থাৎ জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া। পিতা-মাতা সাধারণত জীবন ও জগত সম্পর্কে যে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন শিশুরা তারই অনুসরণ করার চেষ্টা করে। তাই শিশুদের সামনে সঠিক এবং যথাযথ জীবন দর্শন উপস্থাপন করতে হবে।

শিশুর প্রশিক্ষণে সাহিত্যের গুরুত্ব অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প, প্রবাদবাক্য প্রভৃতির মাধ্যমে সাহিত্য নৈতিকতা ও সভ্যতার জ্ঞান শিক্ষা দেয়, মানুষকে তার লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। এ কারণে প্রত্যেক পিতারই উচিত তার সন্তানের পড়ালেখার জন্য এবং তার জ্ঞান বিকাশের জন্য উপযুক্ত বই-পুস্তক নির্বাচন করা। এমন অনেক বই-পুস্তক রয়েছে যা ধ্বংসাত্মক জ্ঞানের উৎস। যে সকল বইয়ে নৈতিক গুণাবলি শিক্ষার কিছু থাকে না সে সকল বই-পুস্তক শিশুদের জন্য মারাত্মক হতে পারে। এ নীতিজ্ঞান বিবর্জিত এবং সুশিক্ষার অভাব সম্বলিত বই শিশুকে কোন জ্ঞানই দেয় না; বরং তার ভবিষ্যত জীবনকে মূর্খতা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে দেয়। তাই শিশু কী পাঠ করছে এবং তাকে কী পড়তে দেয়া উচিত সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। খেয়াল রাখতে হবে শিশু যেন আজেবাজে বই-পুস্তকের দিকে আকৃষ্ট হয়ে না পড়ে।

সাহিত্যের মতো শিল্পকলাও শিশুর জ্ঞান বিকাশে বিরাট ভূমিকা পালন করে। শিল্পচর্চার প্রতি শিশুদের উতসাহিত করা উচিত। কারণ, শিল্পকলা মানুষের মেধাশক্তিকে প্রখর করে মানসিকতাকে উন্নত করে। শিশুর মাঝে একাগ্রতা, সুনির্বাচন এবং ভালো কিছু করার আকাক্সক্ষা বৃদ্ধিতে শিল্পচর্চার বিকল্প নেই। তাই স্বল্প বয়স থেকেই সন্তানদেরকে শিল্পকলার সাথে পরিচিত করে তোলা উচিত। শিশুরা ছোটবেলা থেকেই অংকন, হস্তলিপি প্রভৃতির চর্চা করতে পারে। এভাবে শিশু তার অবসর সময়টাকে গঠনমূলক কোন কিছুতে ব্যয় করতে পারে। পরিবার অবশ্যই শিশুদের সুকুমার বৃত্তি উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

আমাদের সবার সন্তান, ছোট ভাই-বোন, ভাগ্নে-ভাগ্নী, ভাস্তে-ভাস্তি রয়েছে। তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতিরোধে আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষার মাধ্যমে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যতে অবশ্যই উজ্জল। এজন্যে প্রতিটা পরিবারেই আন্দোলন প্রয়োজন। আমাদের প্রতিটা পরিবারকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারি তাহলে শয়তানের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। আল্লাহ তায়ালা ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবেলায় আমাদের দৃঢ় করুন। আমিন।

শনিবার, ১৪ মে, ২০১৬

মাওলানা নিজামীকে হত্যার প্রতিবাদে মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া


বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে হত্যার নিন্দা জানায় সারা মুসলিম বিশ্ব। তারই কিছু সংকলন করা হয়েছে এখানে।

* ফিলিস্তিনের হামাস: Hamas mourns Jamaat-e-Islami leader Nizami
* ফিলিস্তিনী উলামা পরিষদ: Palestine Scholars Association
* মিসরের ইখওয়ান: Muslim Brotherhood Condemns Execution of Bangladesh Jamaat-e-Islami leader Rahman Nizami
* কাশ্মীরের হিজবুল মুজাহিদীন সভাপতি সালাহ উদ্দিন: Moulana Nizami was a real Islamic leader
* কাশ্মীরের দুখতারান-এ-মিল্লাত প্রধান আছিয়া আন্দ্রাবি:
Toughen stand against Bangla govt.
* জামায়াতে ইসলামী হিন্দ: JIH President condemns the hanging of Bangladesh
* জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান: Ulema condole Nizami’s martyrdom
 Dhaka regime afraid of JI popularity
JI urges raising BD trials, executions with Muslim states
Thousands join funeral for JI BD leader
* পাকিস্তান সরকার: Ministry of Foreign Affairs Government of Pakistan
Pakistan parliament condemns Nizami hanging
* তুরস্কের সর্ববৃহৎ ইসলামী ছাত্র সংগঠন এনাতোলিয়ান ইয়ুথ এসোসিয়েশন: Bangladeshi Jamaat-e-Islami party leader Nizami's execution protested in Turkey
* মালেশিয়ান ইসলামিক ইউথ মুভমেন্ট (আবিম): Execution Of Sheikh Nizami As Wake Up Call For Human Rights In Bangladesh
* মালয়েশিয়ার পাস পার্টি: PAS Kecam Hukuman Mati Yang Telah Dijatuhkan Ke Atas Amir Jamaat-E-Islami Bangladesh
* তুরস্ক প্রেসিডেন্ট এরদোগান: I condemn the mentality that sentences a mujahid to death
* এবং এর প্রতিবাদে তাদের রাস্ট্রদূত প্রত্যাহার: নিজামীর ফাঁসি: বাংলাদেশ থেকে রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করলো তুরস্ক
Turkey withdraws Bangladesh ambassador after execution of Islamist: Erdogan
Nizami’s death penalty not fair governance: Erdoğan
* ইসলামী সার্কেল অফ নর্থ আমেরিকা Execution of Maulana Nizami Strongly Condemned by ICNA
* কুয়েতের ওলামা পরিষদ
جمعية الإصلاح تنعى أمير الجماعة الإسلامية في بنجلاديش
* ইরানের ইসলামি মাজহাব বিষয়ক বিশ্ব সংহতি সংস্থা নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে ইরানের বিশ্ব সংহতি সংস্থার নিন্দা
* ড. তারিক রামাদান: Bangladesh a pendu Motiur Rahman Nizami
* ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ মুসলিম স্কলারস(IUMS) এর প্রধান ড. ইউসুফ আল-কারযাবি: ইউসুফ আল কারযাভীর ওয়েবসাইট
* পাকিস্তানের মুফতি ত্বাকী ওসমানী মুফতি ত্বাকী ওসমানীর টুইটার
* ওমর সুলাইমান ফেসবুক পোস্ট
* সা’দ ইবনে ঘোনাইমের অভিমত বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শায়খ নিজামীর ফাঁসি একটি জঘন্য অপরাধ এবং রাজনৈতিক অধিকারের লঙ্ঘন।
* সৌদী কূটনীতিবিদ আলী আল গামাদি For what sin was Maulana Nizami executed?