সোমবার, ২১ মার্চ, ২০১৬

কেন তাফহীমুল কুরআন পড়বেন?


উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় তাফসীর গ্রন্থ তাফহীমুল কুরআন উর্দু ভাষায় লিখিত। লিখেছেন এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ হযরত সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদুদী রঃ। এই তাফসীরে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা আপনাকে কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।   

বৈশিষ্ট্য 

তাফহীমুল কুরআনের বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আলোচনা করবো যা এই তাফসীরকে অন্যান্য তাফসীর থেকে আলাদা করেছে।
১. কুরআনের সাথে সরাসরি সম্পর্ক: এই তাফসীর এমনভাবে লিখা হয়েছে যাতে পাঠক সরাসরি কুরাআনের সাথে যুক্ত হতে পারেন। নামকরণ, শানে নুযুল, বিষয়বস্তু ধারাবাহিক আকারে এমনভাবে সাজানো হয়েছে পাঠক নাযিলের সময়ের প্রেক্ষাপটের সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পারেন। এটি কুরআন বুঝা এবং আল্লাহর আদেশ বুঝার ক্ষেত্রে খুবই জরুরী।   
তাফহীমুল কুরআনে প্রথাগত বাহাস নেই বললেই চলে। এই কিতাব পুরোপুরি ইসরাইলিয়াতমুক্ত। অতীতে আলোচিত বাহাস ও কালামী বাহাস হতেও মুক্ত এই তাফসির গ্রন্থ। ফিকহি বাহাসও এখানে সীমাবদ্ধ। জাতিগোষ্ঠীগত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কুরআনের আদেশ এবং নির্দেশসমূহের বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। তাফহীমুল কুরআনের ভূমিকায় উসুলে তাফসিরের প্রথাগত বাহাস বা পর্যালোচনার কোন সূত্র পাওয়া যায় না। তাফহীমে কেবলমাত্র শানে নুযুলের বর্ণনা এসেছে একটি ভিন্ন মাত্রায়। এখানে নাসেখ ও মানসুখের বাহাস নেই, মুহকাম ও মুতাশাবেহ আয়াতের বিতর্ক নেই, না আছে এজাযে কুরআনের বাহাস। উপমাসমূহ, প্রকারভেদ এবং কুরআনের কিসসাসমূহ নিয়েও তেমন বাহাস পর্যালোচনা নেই। তবে আবার এমন নয় যে তাফহীমুল কুরআনে এসব একেবারেই নেই। সকল জরুরি এবং প্রয়োজনীয় বিষয়সমূহ নিজ নিজ স্থানে তথা যথাস্থানে যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাফসিরে কুরআনের মৌলিক দৃষ্টিকোণকে হালকা করে দেখা হয়নি। বরং এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে আল কুরআনের বিষয়বস্তু, মূলবক্তব্য, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরবার জন্য। সাথে সাথে কুরআন পাঠকের হৃদয় মনে এমনভাবে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যার দ্বারা এক নতুন মানুষ এবং একটি নতুন মানব সভ্যতা বিকশিত হতে পারে। যেমন সভ্যতা ও মানব সমাজ আল কুরআন দেখতে চায়। এজন্য তাফহীমুল কুরআনের রচয়িতা বিভিন্ন বাহাস বা বিতর্কে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে নিজের শ্রম ও মেহনত কুরআনের মৌলিক বিষয় ও পরিভাষাসমূহ পরিষ্কারভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরার পেছনে ব্যয় করে গেছেন। 

২. কুরআনের নান্দনিকতা : তাফহীমুল কুরআনের দ্বিতীয় অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো কুরআনের অসাধারণ নান্দনিকতা রক্ষা করা। নাযমে কুরআন বা কুরআনের নন্দনতত্ত্ব তাফসীর শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃত। পূর্বের বিজ্ঞ মুফাসসিরগণ ব্যাপকভাবে সূরা সমূহের পারস্পরিক মিল ও ধারাবাহিক সংযোগের উপর বেশি জোর দিয়েছেন। কিছু কিছু মুফাসসিররা আবার আয়াতসমূহের ধারাবাহিক মিল ও পারস্পরিক অন্তমিলের বিষয়টি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন। অন্য একটি দল সমগ্র সূরাকে এক একক ধরে সূরার ভেতরের সব আয়াতকে একটিই মৌলিক বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন এবং সেখান হতেই সূরার সকল বিষয়বস্তু ও আলোচ্য বিষয়কে বের করে এনেছেন। 

তাফহীমুল কুরআনে উপরে আলোচিত সব বিষয়েরই ছোঁয়া পাওয়া যায়। তবে এগুলোর মধ্য হতে নন্দনতত্ত্ব, নান্দনিকতা ও অলংকার শাস্ত্রের সকল সূত্রকে ছাপিয়ে যে বিষয়কে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তা হলো কুরআনের বিষয়বস্তু, এর কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং লক্ষ্যবিন্দুর সাথে প্রত্যেকটি সূরা এবং প্রতিটি আয়াতকে সম্পর্কিত ও সংযুক্ত করা হয়েছে। তাফহীমুল কুরআনে দেখানো হয়েছে ‘‘এই কিতাবটি (অর্থাৎ কুরআন) তার সমগ্র পরিসরে কোথাও তার বিষয়বস্তু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং মূল লক্ষ্য ও বক্তব্য থেকে এক চুল পরিমাণও সরে পড়েনি। 

প্রয়োজন মতো এসব বিষয়ের আলোচনা করার পর কুরআন সবসময় অপ্রয়োজনীয় বিস্তারিত আলোচনা বাদ দিয়ে নিজের উদ্দেশ্য ও কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ের দিকে ফিরে এসেছে। একটি সুগভীর ঐক্য ও একাত্মতা সহকারে তার সমস্ত আলোচনা ‘ইসলামী দাওয়াত’-এর কেন্দ্রবিন্দুতে ঘুরছে।

কুরআনের বর্ণনা করার এই নান্দনিক আবিষ্কার তাফহীমুল কুরআনের এক অনন্য কীর্তি। মওদূদী রহ. তার আলোচনায় যথাসম্ভব পরিভাষাগত জটিল শব্দ ব্যবহার পরিত্যাগ করেছেন কিন্তু তার রচিত তাফসীর এক অনন্য স্বতন্ত্র স্বাচ্ছন্দ্য পরিভাষার জন্ম দিয়েছে। তাফহীমুল কুরআনে প্রত্যেক সূরার বিষয়বস্তু, মূল বক্তব্য ও আয়াতসমূহের বক্তব্যকে আল-কুরআনের মূল লক্ষ্য ও দাওয়াত হতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতুৎপন্নমতিময় দ্রুততার সাথে বের হতে থাকে। 

অতঃপর এটা তাফহীমুল কুরআনের এক অনবদ্য কীর্তি যে এই তাফসির শুধুমাত্র আল কুরআনের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিই দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি বরং কুরআনের এই নান্দনিক সংযোগকে প্রতিটি সূরা এবং কুরআনের সূরাসমূহের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। তাফহীমুল কুরআনের সূরাসমূহের ভূমিকার আলোচনা এক্ষেত্রে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং টীকাসমূহের জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণেও কুরআনের সেই নান্দনিকতা তাৎপর্যপূর্ণভাবে ফুটে উঠেছে। 

৩. তাফহীমুল কুরআনের অনুবাদ: তাফহীমুল কুরআনের অনুবাদ বিভিন্ন দিক হতে স্বতন্ত্র বৈশিষ্টের অধিকারী। শাব্দিক তরজমা না করে তাফহীমুল কুরআনে স্বতন্ত্র ও স্বচ্ছন্দ ভাবানুবাদের একটি পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। কিন্তু অসাধারণ বিষয় হলো কোন একটি ক্ষেত্রেও এই স্বচ্ছন্দ অনুবাদ কর্ম অনুবাদের সীমা অতিক্রম করে যায়নি। তাফহীমুল কুরআনেই ধারাবাহিক স্বচ্ছন্দ অনুবাদ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র অনুবাদ অধ্যয়ন করলেই পাঠকের দেহমনে সেই প্রভাব বিস্তৃত হয় যা কুরআন সৃষ্টি করতে চায়। এই স্বচ্ছন্দ অনুবাদে সেই বাণী শোনা যায় যা কুরআন বলতে চায়। 

তাফহীমের অনুবাদের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এখানে বক্তৃতার ভাষা লেখনীর ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে- ফলে একটি উৎকৃষ্ট অনুবাদ কর্মের সাথে সাথে এটা কুরআনী জ্ঞান চর্চার নতুন এক মাইল ফলক উন্মোচন করেছে। তাফহীমুল কুরআনের তরজমাতে বক্তৃতার ভাষাকে সাহিত্যের ভাষায় রূপান্তরে মাওলানা মওদূদী র. অর্থের গুরুত্ব বিচারে প্যারাবদ্ধ করেছেন। এই পদ্ধতিতে বয়ানের সিলসিলার সাথে সাথে একটি বিষয় হতে অন্য বিষয়ে যাবার সংকেত ও নির্দেশিকাও দিয়ে দেয়া হয়েছে। 

৪. সূরা সমূহের ভূমিকা : তাফহীমুল কুরআনের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সূরাসমূহের ভূমিকাও অন্যতম। প্রতিটি সূরার তাফসীর ও তরজমা শুরু করবার পূর্বে মওদুদী রঃ সংশ্লিষ্ট সূরার ঐতিহাসিক পটভূমি, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়, বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সূরা সমূহের কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং বিষয়বস্তুর সম্পর্ক ও ধারাবাহিকতাকে কুরআনের সম্মিলিত লক্ষ্যবিন্দু, কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয় এবং কুরআনের মূল দাওয়াতের সাথে সম্পর্কিত করে বর্ণনা করা হয়েছে। নাযিল হওয়ার সময়কাল ও নাযিল হওয়ার উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনা করে তার চমকপ্রদভাবে বিবৃত করা হয়েছে।  

৫. আহকামে কুরআন : তাফহীমুল কুরআনের আরও একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর মধ্যে বর্ণিত ফিকহী নির্দেশসমূহ। কুরআনের যে আয়াত হতে কোন নির্দেশ পাওয়া গেছে তা সেখানেই তথা যথাক্রমিক স্থানেই বলে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া অন্য যে সমস্ত জায়গায় একই বিষয় আলোচিত কিংবা বর্ণিত হয়েছে তাও বলে দেয়া হয়েছে। এইভাবে তাফহীমুল কুরআনে কুরআনের তাফসীর করার চেষ্টা করা হয়েছে খোদ কুরআন হতেই। আরও যে বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা হয়েছে তা হলো প্রতিটি বিষয়ে কুরআনের মূল শিক্ষা এবং কুরআন প্রদর্শিত চরিত্রনীতি ও সংস্কৃতির মৌলিক অবকাঠামোর আলোকে বিষয় বিবরণী ও নির্দেশনা দেয়া হোক। সাথে সাথে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর অবস্থান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হোক। নবী করীম সা. ও সাহাবায়ে কেরাম (র.) কোন আয়াত কিংবা নির্দেশের যে তা’বীর ও ব্যাখ্যা করেছেন তাফহীমুল কুরআনে তাও বিবৃত করবার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে সাহাবাদের মধ্যে অথবা আলেমদের মাঝে মতভেদ দেখা দিয়েছে তাও বিবৃত করা হয়েছে; সাথে সাথে মতভেদের ভিত্তিও বলে দেবার চেষ্টা করেছে তাফহীমুল কুরআন। সাধারণভাবে কোন ব্যাখ্যায় হানাফী চিন্তাধারার আলোকে মূল ব্যাখ্যা করা হলেও অন্যদের দৃষ্টিকোণও তুলে ধরা হয়েছে। এ দৃষ্টিকোণ হতে তাফহীমুল কুরআনে ফিকহী মাযহাবসমূহের মতামতের যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে তা আগামী দিনের গবেষকদের জন্য অত্যন্ত সাহায্যকারী উপাদান ও ফলপ্রসূ হতে পারে। সাথে সাথে সম্মিলিতভাবে উম্মতের ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থাপনেও নতুন পথের সূচনা করবে।

৬. আহলে কিতাবদের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা : তাফহীমুল কুরআনে ইহুদীবাদ, খ্রিষ্টবাদ এবং কুরআনের তুলনামূলক পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই পর্যালোচনাসমূহে বাদানুবাদের পরিবর্তে চেষ্টা করা হয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মবেত্তা’ যাজক শ্রেণী এবং পশ্চিমা কর্তৃক উত্থিত প্রশ্নসমূহের সাধ্যমত ন্যায়সংগত এবং সমাধানমূলক উত্তর দেবার। অতঃপর অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে আল কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী এবং বর্তমান বাইবেলের লিখিত রূপের পরিষ্কার পার্থক্য। যেন বিকৃত ওহী এবং অকাট্য অবিকল ওহীর মধ্যকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মানুষ যেন আসল বিষয়টি বুঝতে পারে। মওলানা মওদূদী রহ. আল কুরআনকে নিজস্ব দলিল প্রদানের ভিত্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে অতঃপর অন্যান্য ধর্মমত আলোচ্য বিষয়কে যেভাবে পেশ করে তার তদ্রূপ সমালোচনা করে দুটোর পার্থক্যকে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। নিজের অবস্থানকে তুলে ধরবার জন্য তিনি ঐতিহাসিক দলিল প্রমাণ, আধুনিক বাইবেলের সমালোচনা ও অন্যান্য জ্ঞানবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনসমূহকে উপস্থাপন করেছেন। একইভাবে তিনি আধুনিক মতবাদসমূহ এবং সেই যুগে উত্থিত আন্দোলনসমূহের যাচাই পর্যালোচনা এবং সমালোচনা করেছেন এবং সেই মতবাদ ও আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত লোকের আল কুরআনের যে মনগড়া অপব্যাখ্যা করার অপচেষ্টা করেছিল তিনি তার বিপরীতে সুচিন্তিত বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছেন। তার তাফসীরে পদার্থবিদ্যা, জীববিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, জ্যোতিবিদ্যা, শারীরবিদ্যা এবং ভূগোল থেকে শুরু করে অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, দর্শন ও যুক্তিবিদ্যা, ইতিহাস ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের বেশুমার আলোচনা ও পর্যালোচনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তিনি জ্ঞানরাজ্যের ঐ সকল শাখা হতে কমবেশি অনেক কিছু নিয়েছেন কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি কুরআনকে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হিসেবে বিবেচিত করেছেন। 

৭. রেনেসাঁর বা পুনর্জাগরণের ধারণা : তাফহীমুল কুরআনের আলোচনা থেকে যেটা প্রতীয়মান হয় সেটা হলো সনাতন ও নতুনের মাঝে রেনেসাঁর বোধ তথা জীবন ধারণ ও যাপনের জন্য নতুন দিনের জীবনবিধান। মওলানা মওদূদী রহ. এর কলম সবসময় চরম ও পরমপন্থার পথ পরিহার করে চলেছে। যারা খোদার দীনকে মসজিদ-মিম্বার, ব্যক্তিগত জীবন ও খানকাহের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ করেছিলো মওলানার কলম তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠেছে, প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। যারা ইসলামের নাম নিয়ে ধর্মের আলখেল্লা পড়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার কথা বলে কুরআনের আদেশ নিষেধবাণীকে ছেলেখেলার বস্তুতে পরিণত করেছে তিনি কঠোর ভাষায় তাদের সমালোচনা করেছেন। মওলানা মওদূদী রহ. এর বক্তব্যের মূলকথা ছিলো এমন ধারণা ও প্রেরণা জন্মাতে হবে যে, আল কুরআন মোতাবেক নিজেকে বদলে ফেলতে হবে। এটাই ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলন সমূহের সংগ্রামী দাওয়াত ও কর্মনীতি। তাফহীমুল কুরআন নবুয়্যতের যুগ হতে আজ পর্যন্ত উম্মতের সত্যনিষ্ঠ জনমন্ডলীর অনুসৃত এই কর্মনীতিকেই তুলে ধরেছে এবং হেদায়েতের এই রাজপথকে উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর আলোতে উদ্ভাসিত করবার চেষ্টা করেছে। 

৮. নতুন ভাবে কুরআন থেকে শিক্ষাগ্রহণ : তাফহীমুল কুরআনের আরও একটি বিশেষত্ব হলো এই কিতাব একটি নয়া ইলমে কালামের ভিত্তি গড়েছে। প্রতিটি যুগের মাসলা-মাসায়েল এবং যুক্তিতর্ক বাহাস ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। প্রত্যেক কালে ও যুগের জ্ঞান বিজ্ঞানের নিজস্ব স্তর হয়। সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানসমূহও পৃথক পৃথক হয়ে থাকে। কালস্রোতে যেগুলোর চলন ও প্রভাব চলে আসে। খ্রিষ্টান ধর্ম যাজকরা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন এমনকি স্যার সাইয়েদ স্কুলের পক্ষ হতে যেসব উক্তি করা হয় সেসব প্রশ্নকরণের জবাব দেয়ার ব্যবস্থা আমাদের যুগে অবশ্যই করা হয়েছিল। কিন্তু একথাও একটি বাস্তব সত্য পাশ্চত্য নিশানা লক্ষ্য টার্গেট জ্ঞান ও শিল্পকলার টার্গেট করা হয়নি, যার ছত্রছায়ায় তারা এই সব উক্তি করছিল কিংবা প্রশ্নবান ছুড়ে দিচ্ছিল কিংবা আপত্তি উত্থাপন করছিল। 

নতুন ইলমে কালামের মৌলিক কথা : 
ক. কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষা ও নির্দেশনাকে মৌল ভিত্তি ধরে এটা প্রমাণ করা হয়েছে যে ধর্মের নামে যে ভুল ধারণা ও কুসংস্কার বর্তমান জমানায় প্রচলিত হয়েছে এ সবের একটি মৌলিক কারণ হলো কুরআনের সামগ্রিক শিক্ষাকে এবং কুরআনের বাস্তব জীবন দর্শনকে সুন্নাতে রাসূল সা. এর আলোকে না দেখে খন্ডিত রূপে দেখা হয়েছে। 

খ. এই ইলমে কালামের রূপদানের সময় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খেয়াল রাখা হয়েছিল যে যুগের সেই প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের প্রকৃত দুর্বলতা সমূহ যেমন অজ্ঞতা, সমসাময়িক মতবাদসমুহের প্রতি আনুগত্য, মুনাফেকী, একটি বিশেষ গোষ্ঠীর মাঝে বেপরোয়া বুদ্ধি বিকৃতির অসৎ বাণিজ্য। তাই এর প্রতিকার এমনভাবে করা হোক যে ইসলামের শিক্ষাকে ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটিয়ে দ্বীনের শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে অজ্ঞতার অন্ধকার মুছে ফেলতে হবে। পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ভিত্তিসমূহ পাশ্চাত্যের অন্যতম জীবন দর্শনসমূহ ও তাদের উত্থিত আন্দোলন সমূহের উপর সর্বাত্মক হামলা চালানো হোক এবং সমালোচনা করে পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দেয়া হোক ওসবের কি ভালো ও কল্যাণকর এবং কোনটি ভ্রান্ত এবং বিভ্রান্তির উদ্যোক্তা। এই আক্রমণ চলবে পাশ্চাত্যের ধর্মহীন সমাজ ব্যবস্থার উপর তাদের চারিত্রিক হীন উদ্দেশ্য, ঔনিবেশবাদ, তাদের সাংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন এবং অধঃপতিত সমাজ চরিত্রের উপরও সমালোচনা করতে হবে। এইভাবে যাতে করে পরাধীনতার তমশাচ্ছন্ন রাতের নিদ টুটে যায় এবং পরাভব কমে যায় এবং নিজের তাহযীব ও তমদ্দুনের উপর আস্থা বিশ্বাস বাড়ে। মুনাফেকী এবং দ্বৈত নীতির উপর সমালোচনার তীব্র তীর বর্ষণ করতে হবে যেন যে মুসলমান হয়ে থাকতে চায় সে যেন একজন পরিপূর্ণ মুসলিম হয়। অন্য দিকে যে অন্য জীবন বিধানসমূহের সাহায্যকারী হতে চায় সে যেন পর্দার আড়ালে নিজেকে ঢেকে রেখে অন্যদের ধোকা দিতে না পারে। এইভাবে যেসব লোক দীনের ব্যাপারে প্রকাশ্যে আমানতের খেয়ানত করেছে তাদের জ্ঞানগত হীনতা চারিত্রিক দুর্বলতাকে উম্মোচিত করা হোক যাতে তারা তাদের প্রকৃত স্বরূপ মানুষের সামনে উম্মোচিত হয়। 

গ. এই ইলমে কালামে প্রকৃতিগত ভাবেই জ্ঞানের উৎসের সাথে সংলাপ ও কথোপকথনকে একটি বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। ইউরোপের আসল দাবীই হলো অহী হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় বস্তু। মানুষের বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাই সভ্যতা সংস্কৃতির ভিত গঠনের জন্য যথেষ্ট। পক্ষান্তরে ইসলামের দাবি হলো বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা তখনই লাভজনক হবে যখন ওহীর আলোকে তা কাজে লাগানো হবে। নইলে আলো যতই থাকুক না কেন বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা বাস্তবতার কোন কিছুই দেখতে পায় না। যেমন- মানব চক্ষু অন্ধকারে কিছুই দেখে না। ওহীর রোশনাই হলো পবিত্র কুরআন শরীফ। এই আধুনিক ইলমে কালামে ওহী, বুদ্ধি-বিবেক এবং অভিজ্ঞতার যথাযথ মর্যাদা তুলে ধরবার চেষ্টা করা হয়েছে। অতপর আধুনিকতা ও উত্তর আধুনিকতার জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যাপারে এটা পরিষ্কারভাবে বলে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ওসবের ক্ষেত্র সীমা পরিসীমা কতটুকু।

ঘ. এই ইলমে কালাম যুক্তি উপস্থাপনায়ও যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে তা মানব অন্তরের সুমতির নিকট কেন্দ্রীয় গুরুত্বের দাবী রাখে। তাফহীমুল কুরআনে পদে পদে মানব অন্তরের এই সুমতির কাছে নিবেদন করা হয়েছে এবং চেষ্টা করা হয়েছে। এটাই হলো আল-কুরআনের দলিল প্রমাণাদি উপস্থাপনের এক অনুপম পদ্ধতি। আধুনিক ইলমে কালামে এই যুক্তি প্রদান পদ্ধতিই অবলম্বন করা হয়েছে। 

ঙ. আল কুরআনের অনুসৃত যুক্তি উপস্থাপনের একটি অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে সে বিরুদ্ধবাদীদের গৃহীত মূলনীতি ও স্বীকৃত জ্ঞান দ্বারাই তাদের নিরুত্তর তথা লা-জবাব করে দেয়া। উপমা স্বরূপ হযরত ইবরাহিম আ. এর জাতিকে উদ্দেশ্য করে জাতির সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়েছে তোমরা যে বড় সাইজের মূর্তিকে তোমাদের মাবুদ এবং সকল কাজের কারিগর হিসেবে জানো ও মানো তার ব্যাপারে এটা মানতে রাজী নও কেন? যে, সে অন্য ছোট ছোট মূর্তিকে ভেঙে ফেলেছে। আধুনিক ইলমে কালামে পাশ্চাত্যের সমালোচনা করার সময় সামগ্রিকভাবে এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। তাফহীমুল কুরআনে এর নেহায়েত উচ্চাংগের সুনির্বাচিত উপমা দেখা যায়। 

চ. তাফহীমুল কুরআন যে নয়া ইলমে কালামের প্রবর্তন করেছে সেখানে ইসলামী আইন প্রণয়নের কৌশল, যুগের মাসলা-মাসায়েলের সমাধান ও অন্যান্য আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের উন্নতি ও প্রসারকে তুলনামূলক পর্যালোচনা হিসেবে নিয়ে আসা হয়েছে এই বস্তু একদিকে কুরআনের প্রদর্শিত শিক্ষাসমূহের উপর আস্থা ও বিশ্বাসকে বাড়িয়ে তোলে অন্যদিকে খোদায়ী কালাম হিসেবে কুরআনের পক্ষে দলিল যা কিনা একথাটি প্রমাণ করে যে কুরআনী শিক্ষার মানদন্ডের উপর যুগের উত্থান-পতন কিংবা অতি বিপ্লবী চিন্তার কোন প্রভাবই পড়ে না। কুরআন বিংশ শতাব্দীতেও অতটাই তরতাজা এবং অত্যাধুনিক যতটা ছিল সপ্তম খৃষ্টাব্দে। 

৯. বিষয় নির্দেশিকা: তাফহীমুল কুরআনের আরও একটি অসামান্য বৈশিষ্ট্য এর বিষয় অভিধান। ইংরেজী ভাষায় একে ইনডেক্স বলে। আমরা বাংলাতে সূচী, নির্ঘণ্ট, নির্দেশিকা, কোষগ্রন্থ, অভিধান প্রভৃতি বলে থাকে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অনেক বিচিত্র, মূল্যবান এবং অতুলনীয় বিষয় অভিধান কিংবা কোষগ্রন্থ পাওয়া যায় পৃথিবীর নানা ভাষায়। কিন্তু তাফহীমুল কুরআনের স্বতন্ত্র বিষয় অভিধান এর নিজ তুলনায় স্বয়ং তুলনাহীন। এটা কুরআন ও তাফহীমুল কুরআনের তামাম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও সূচীর এক স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি। আল কুরআনের যেখানে যেখানে কোন নীতি নির্ধারণী বিষয় কিংবা কোথাও কোন ছোট খাট বিষয়ের আলোচনার অবতারণা ঘটেছে সেসব কিছু অত্যন্ত যত্নসহকারে এই নির্ঘণ্টে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেসব গবেষক মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিয়ে গবেষণা করেন তাদের জন্য কুরআনের বিষয়াবলীর বিশালতা এবং নির্দেশিকার প্রসারতার সামনে এই বিষয় অভিধানকে একটি অন্যতম নেয়ামত মনে হবে। তাফহীমুল কুরআনকে যদি জ্ঞানের একটি বিশ্বকোষ ধরা হয় তাহলে এই নির্ঘণ্ট সেই বিশ্বকোষে গিয়ে চড়বার সিঁড়ির সাথে তুলনীয়। 

আশা করছি কুরআন বুঝার ক্ষেত্রে এবং নির্যাস আস্বাদন করতে তাফহীমুল কুরআন পাঠ অনন্য ভূমিকা রাখবে। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা আমাদের সবাইকে কুরআন অনুধাবন এবং সে অনুসারে আমল করার তাওফীক দান করুন। 

0 মন্তব্য(গুলি):

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন